সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও ছাতক দোয়ারাবাজার অবস্থা অপরিবর্তিত,দুর্ভোগ চরমে। গত ২৪ ঘন্টায় ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল নামা বন্ধ থাকায় সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও বিশ্বমভর পুর ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও জেলার ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ছাতক উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানি বন্দি অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ছাতকের ৬ টি পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে সড়ক, বসত বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ শত শত একর ফসলের খেত তলিয়ে গেছে। ছাতক সিলেট সড়কের ১৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১০ কিলোমিটারই ডুবে যোগাযোগ ও যান চলাচল বন্ধ আছে। জরুরী প্রয়োজনে নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করছেন। ঢলের পানিতে অধিকাংশ টিউবওয়েল পানির নীচে থাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন পানি বাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। উপজেলার মৎস্য খামারিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকের চাষকৃত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ছাতক উপজেলার বিভিন্ন জায়গাতে ১৪ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং ত্রাণ সহ শুকনো ও রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে।উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো মামুনুর রহমান জানান দুর্গতদের পাশে আছেন সতর্ক অবস্থানে আছেন।
দোয়ারাবাজার উপজেলার বিভিন্ন জায়গাতেই পানি কিছুটা কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। উপজেলার সাথে গ্রামীণ সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। এমনকি জেলা সদরের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। নৌকা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই চলাচলের জন্য। বিদুৎতে বিহীন অবস্থায় থাকায় পুরো উপজেলা ভূতুরী অবস্থায় আছে। আলী পুর গ্রামের কৃষক কাজল মিয়া জানান হাওরের উঁচু জমিতে থাকা খেতের ধান এখনও কাটতে পারেন নি পানি কমলে কাটতে পারবেন কি না দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। দোয়ারাবাজার উপজেলার অনেক চাষকৃত পুকুরের মাছ ভেসে গিয়ে মৎস্য চাষীগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মৎস্য চাষী সিরাজ মিয়া জানান আমি ৫ টি পুকুরে মাছ চাষ করি একটি পুকুরের মাছ ও ধরিনি সব পানিতে ভেসে গেছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ও চাষকৃত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে পানির সাথে। মৎস্য চাষী শেরুল মিয়া ও কালা মিয়া জানান কয়েকটি পুকুরে মাছ চাষ করি ধার দেনা করে সব ভেসে গেছে পানিতে এখন পথে বসার উপক্রম। কিভাবে ঝণ শোধ করব খাব কিভাবে এখন এটাই চিন্তার বিষয়।
সুনামগঞ্জ জেলার-৫টি উপজেলার ২১৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করার ফলে সাময়িক বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে এবং ২৮ টিতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পানি কমলে যথারীতি বিদ্যালয় খুলবে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমান। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায় গত ২৪ ঘন্টায় ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ও সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল আসা বন্ধ থাকার ফলে সুরমা নদীর পানি ১৭ সেন্টিমিটার কমে ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সাথে তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার উচু জমিতে যাকে নন হাওর বলা হয় সেসব হাওরের অনেক ফসল তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে জেলায় ৫শ হেক্টর বোরো ধান (নন হাওর ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সাথে দুই উপজেলার প্রচুর বাদাম ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে ৫০ হেক্টর জমির বাদাম ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের বারহাল গ্রামের বাদাম চাষি মোহাম্মদ আলী জানান, এবার করফুলার হাওরে মোট ৪ কেয়ার(৩০ শতাংশে ১ কেয়ার) খেতে বাদাম চাষ করেন। তার প্রতি কেয়ারে খরচ হয় ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকার মতো। ওই বাদাম ১০/১২ দিন আগেই তোলার কথা ছিল। কিন্তু টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাদাম খেত ডুবে যাওয়ার কারণে বাদাম খেত থেকে বাদাম তোলা সম্ভব হয়নি। আজ বৃষ্টি না থাকায় পানির মধ্যেই বাদাম তুলছি। ১০/১২ দিন পানির নিচে থাকার কারণে বাদামের গুড়া পচে গিয়ে একভাগ বাদাম মাটিতেই থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাদামের রং লাল ও কালো হয়ে গেছে। এই বৃষ্টির কারণে আমার মতো এই হাওরের শতশত কৃষক খুবই কষ্টের মধ্যে পড়েছি।
একই গ্রামের কৃষক খোকন মিয়া জানান, এই হাওরে তারও ৩ কেয়ার বাদাম ও ৫ কেয়ার ধান ছিল। বৃষ্টির জন্য ধান ও বাদাম কোনটাই তিনি তুলতে পারেননি।
টানা বৃষ্টি পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে তাদের মতো একই অবস্থা উপজেলার বলদার হাওর, রসুলপুরের হাওর, ঘিঘড়ার হাওর, মোল্লাপাড়া হাওর সহ কৃষকদের রোপন করা কষ্টের ফসল বাদাম ও ধান নিয়ে আছে অনেক বেকায়দায় ও কষ্টের মধ্যে।
খাসতাল গ্রামের কৃষক জহুর মিয়া(৭০), শাহজাহান (৪৫) দুজনেই জানান, এবার আবহাওয়া ভালা( ভালো) দেখে বিকির বিল হাওরে মিশিনের( বোর জমি) জমি করছিলাম ১৫/১৬ কানি( কেয়ার)। ৭/৮ কানি ( কেয়ার) ধান কাটছি। কাটটাও পড়লাম বিপদে। ১২/১৩ দিনের বৃষ্টি থাকায় ধানও শুকাতে পারছিনা। বন ও শুকাতে পারছি না। ধান বন দুওডাই পইচা গেছে। আরও আইছে গোলা( বন্যা) যা খেত কাটার বাকি আছিন এখন এগুলোও পানির নিচে। আল্লায় যে কি চাইছে? এবার যে কি খামু বুঝতম পারতাছি না।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান বন্যা দুর্গতদের জন্য ইতিমধ্যেই ১৫ মেট্রিক টন চাল আড়াই লক্ষ নগদ টাকা, শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। আমরা তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্ত দের সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের আওতায় নিয়ে আসব।