১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠি ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। তারা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজী হচ্ছিল না। উল্টো বাংলাদেশের (তৎতকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নাগরিকের উপর শোষণ আর নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়। এতে করে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দিনদিন তীব্র আকার ধারণ করছিল। ওই আন্দোলনে সিলেটের সর্বস্তরের ছাত্রজনতা সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। আন্দোলনরত ছাত্রজনতা ঘরবাড়ি ছেড়ে আন্দোলনকে গ্রামীণ জনপদ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়। সিলেটসহ মহকুমা শহরগুলো উত্তাল করে তোলেন ছাত্রজনতা। তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘনিয়ে আসে ২৫ মার্চ। ২৫ মার্চ ছাত্রজনতা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সিলেট শহরে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। পুরো শহর বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ আর বেরিকেডের কারণে উত্তাল হয়ে উঠে। এদিনের আন্দোলনের অংশ নিতে সিলেট শহরসহ আশপাশ এলাকার লোকজন শহরের সমবেত হয়ে সকল কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করেন। ওইদিন শহরসহ আশপাশ এলাকার ঘরবাড়িতে কোনো পুরুষ ছিল না। সবাই আন্দোলনে অংশ নিতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরেই অবস্থান করছিলেন। রাত ১২ টায় খবর আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় নিরীহ মানুষের উপর হামলে পড়েছে। ব্রাশ ফায়ার করে এদেশের মানুষকে হত্যা করছে। ওই খবর পেয়ে সকর্ত হয়ে উঠেন সিলেটের আন্দোলনরত ছাত্রজনতা। নেতারা গভীর রাতে জরুরি সভায় বসেন। পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এ-এলাহী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে সিলেটের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন দৈনিক বায়ান্নের কাছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এ-এলাহী ১৯৭১ সালে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্র হিসেবে বসবাস করতেন। ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। হানাদার বাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে একাধিকবার আহত হয়েছেন তিনি। সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউেিনটর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন তিনি।
২৫ মার্চের ঘটনা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এ-এলাহী জানান, আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে শহরের নানান প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জিন্দাবাজার পয়েন্টের। আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে তখনকার ছাত্রনেতাদের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। ওইসব ছাত্র নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, এডভোকেট লুৎফুর রহমান (সর্বশেষ তিনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন), সাবেক এমপি শাহ আজিজুর রহমান, মকসুদ ইবনে আজিজ লামা, সদরুদ্দিন চৌধুরী, এনামুল হক চৌধুরী বীর প্রতীক, রফিকুল ইসলাম, সিরাজ আহমদ, এমএ বাছিত, এডভোকেট মুজিবুর রহমান, ড. সাইদুর রহমান মাহতাবসহ অনেকে। পরবর্তীতে এসব ছাত্রনেতা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
তিনি জানান, হানাদার বাহিনী ঢাকার রাজপথে নেমেছে ও মানুষ হত্যা করছে-এই খবর পাওয়ার পর ছাত্রজনতা স্টেডিয়াম এলাকার স্যুটিং ক্লাবে হামলা চালায়। লুট করে সেখানে রক্ষিত রাইফেল। ২৫ মার্চ গভীর রাতে সিলেট আরো উত্তাল হয়ে উঠে। ২৬ মার্চ দিনব্যাপী শহরময় বিক্ষোভ চলে। রাতেও চলে একই অবস্থা।
এশার নামাজের পর পুলিশ লাইনে হামলা করে ছাত্রজনতা। হামলা করতেই বাঙালি পুলিশ ছাত্রজনতার কাতারে চলে আসেন। পাকিস্তানি পুলিশ পালিয়ে যায় পুলিশ লাইন ছেড়ে। সকল অস্ত্র লুট করা হয় পুলিশ লাইনের। রাত ১২ টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিলেটের মাঠে নামে।
হানাদার বাহিনী মাঠে নামতেই মাসুক-এ-এলাহী সঙ্গীদের নিয়ে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অবস্থান নেন। ৩০-৪০ জন ছাত্র ছাত্রাবাসে অবস্থান করছিলেন। রাত পোনে একটায় হানাদার বাহিনী ছাত্রাবাসা ঘেরাও করে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। ওই অবস্থায় ছাত্ররা ছাত্রাবাসের পেছন দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই ছড়া দিয়ে তাঁরা সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহ.) মাজার এলাকায় গিয়ে উঠেন। সুরমা নদী পারি দেন সাঁতরে। হবিনন্দি এলাকায় গিয়ে রাস্তার উপর অবস্থান নেন মাসুক-এ-এলাহী ও সঙ্গিরা।