ঢাকা, শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮শে বৈশাখ ১৪৩১

করিমগঞ্জ থেকে ইন্দ্রনগরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এ-এলাহী

এমএ রহিম, সিলেট: | প্রকাশের সময় : বুধবার ২৩ অগাস্ট ২০২৩ ১২:৫৮:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে উল্লাস প্রকাশ করছিলেন মাসুক এলাহীসহ অন্যরা। কিন্তু ওই উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। হায়েনার দল জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতেই তাঁদের সেই উল্লাস থেমে যায়।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের তৎপরতা নিয়ে দৈনিক বায়ান্নের কাছে বিস্তারিত তুলেন রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এ-এলাহী খাঁন।  

 

তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বেলা আড়াইটার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে ফায়ার শুরু করতেই জকিগঞ্জ সদরে ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যাঁরা পাকিস্তানি পতাকা জ্বালিয়ে দেন এবং বাংলাদেশি পতাকা উড়িয়েছিলেন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন ওই ব্রাশ ফায়ারের মুখে। যে যেদিকে পারেন সেদিকে পালিয়ে যান। বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এ-এলাহী খাঁন, মনির, কুটু ও তার কয়েকজন সঙ্গি কুশিয়ারা নদীর তীরের দিকে ছুটে যান। পেছনে পেছনে ধাবমান ছিল হায়েনার দল। কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিলেই করিমগঞ্জ শহর। মাসুক এলাহীসহ সঙ্গিরা ঝাপিয়ে পড়েন কুশিয়ারা নদীতে। সাঁতরে নদী পাড়ি দেয়ার সময় তাঁদের পরিধানের পোশাক খুলে যায়। পোশাক ছেড়েই সাঁতরাতে থাকেন করিমগঞ্জের তীরের দিকে। সাঁতরে নদীর মাঝামাঝি। করিমগঞ্জ প্রান্ত থেকে পূর্ব পরিচিতি কয়েকজন তরুণী চিৎকার করে বলছিল ‘পেছনে চেয়ে দেখ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।’ মাসুক এলাহী হাত উঁচু করে চুপ থাকতে বলেন। সাঁতরে করিমগঞ্জ প্রান্তে পৌঁছেন মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা। পূর্বপরিচিত মেয়েরা অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা নদী থেকে উঠছিলেন না। কয়েক মিনিট কেটে যায়। এক পর্যায়ে মাসুক এলাহী জানালেন নদীর পানিতে ভেসে গেছে পরিধানের পোশাক। তাঁদের জন্যে পোশাকের ব্যবস্থা করতে বলেন। বাসার অন্য কাউকে দিয়ে পোশাক পাঠাতে বলেন। এই কথা শুনে মেয়েরা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছিলো। বাসায় ফিরে মেয়েরা পোশাক পাঠায় বৌদিদিদের মাধ্যমে। কারণ তখন বাসায় কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না। পোশাক পরিধান করে তীরে উঠে আসেন মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক এলাহী জানান, করিমগঞ্জে পূর্ব পুরুষের বসবাস ছিল। তাঁর জন্মস্থানও করিমগঞ্জ। যার জন্যে শৈশবের অধিকাংশ সময় কেটেছে করিমগঞ্জে। সেখানে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে মাসুক এলাহীর পরিবারের। স্বাভাবিক অবস্থায় সেখানকার লোকজনের সাথে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। নদীর তীরে যেসব মেয়ে মাসুক এলাহীকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁদের সাথে পারিবারিকভাবেই ঘনিষ্ঠতা ছিল মাসুক এলাহীর।

 

তিনি জানান, হিন্দুয়ানা পোশাক পরিধান করে করিমগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতেই অনেকে অনেকটা অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলেন। কারণ করিমগঞ্জ শহরে মাসুক এলাহী সবসময় নিজস্ব পোশাক পরিধান করে গেছেন। আজ হিন্দুয়ানি পোশাক পরিধান করে শহরে প্রবেশ করেছেন। স্বাভাবিকভাবে এ নিয়ে অনেকে কৌতহলী হয়ে উঠেন। কেউ কেউ এগিয়ে জানতে চাচ্ছিলেন কুশল। খবর পেয়ে ছুটে আসেন করিমগঞ্জ টাউন ক্লাবের সভাপতি শিবাজী। পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে জানতে চান। কারণ জানতে পারেন শিবাজী। নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উঠেন মাসুক এলাহী। সাথে ছিলেন সঙ্গিরা। দোকানের ম্যানেজার মাধব তটস্থ হয়ে উঠেন মাসুক এলাহীর অবস্থা দেখে। ছোট সাব, ছোট সাব বলে জানতে চান কারণ। কারণ জেনে টেইলার ডেকে আনেন। তাৎক্ষণিক পোশাক তৈরি করে দেয়ার জন্যে বলেন। মাপজোক নিয়ে ঘন্টা, দেড় ঘন্টায় মাসুক এলাহী ও সঙ্গিদের পোশাক তৈরি করে দেন টেইলাররা। পোশাক তৈরিতে একসাথে কয়েকজন টেইলার কাজ করেন।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক এলাহী জানান, ম্যানেজার মাধবের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় মাসুক এলাহীর হাতে ৪০০ টাকা ধরিয়ে দেন হাত খরচের জন্যে। মাধবের স্ত্রী লুকিয়ে আরো ৫০০ টাকা দেন। নতুন পোশাক পরিধান করে এলংজুরিতে যান। উঠেন মামা আবদুস শুকুর লস্করের বাড়িতে। মামার বাড়ির লোকজনের মধ্যে হৈচৈ পড়ে যায়।

 

তিনি জানান, জকিগঞ্জের বাড়িতে অবস্থানরত তাঁর পিতা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাসুক এলাহীকে। জকিগঞ্জ সীমান্তে কুশিয়ারা ঘাটে যান মাসুক এলাহীর পিতা। নদীর বিপরীত তীরে অবস্থিত করিমগঞ্জের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মাধবকে ডাকেন হাক দিয়ে। মালিকের হাক-ডাকের খবর পেয়ে ম্যানেজার মাধব ছুটে আসেন কুশিয়ারার তীরে। এপার থেকে মাসুক এলাহীর অবস্থান জানতে চান পিতা। ম্যানেজার মাধব জানিয়ে দেন মাসুক এলাহী করিমগঞ্জে এবং তাদের হেফাজতে আছেন। পিতা নির্দেশনা দেন, সে যেন (মাসুক এলাহী) কোথায়ও না যায়। মামার বাড়িতেই সঙ্গিদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন মাসুক এলাহী।

 

তিনি জানান, দ্রুতই তাঁদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে। করিমগঞ্জ টাউন হলে ছিল রিক্রুটিং সেন্টার। কিন্তু এই সেন্টারে গিয়ে অংশ নেয়া থেকে সরে দাঁড়ান কৌশলগত কারণে। সিদ্ধান্ত নেন আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। এজন্যে মামার পরিবারের সদস্যদের ফাঁকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।  

 

২-৩ দিনের মাথায় মামীর কাছে বায়না ধরেন। তাঁরা শীলচরে গিয়ে সিনেমা দেখতে চান মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা। মামী রাজী হয়ে যান। দুইজনকে সাথে দিয়ে মাসুক এলাহী ও সঙ্গিদের শীলচরে পাঠান। শীলচরে গিয়ে সাথে যাওয়া দুইজনকে ম্যানেজ করেন মাসুক এলাহী। এই দুইজন বাড়ি ফিরে যাতে বলেন মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা শীলচর শহরে তাদের দুইজনকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছেন। একইসঙ্গে মাসুক এলাহী বললেন কংগ্রেসের কারো সাথে পরিচয় থাকলে তাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। শীলচরের কংগ্রেসের এক নেতার কাছে মাসুক এলাহী ও সঙ্গিদের নিয়ে গেলেন সাথে যাওয়া দুইজন। মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে যেতে চান বলে জানান ওই কংগ্রেস নেতাকে। এজন্যে তাঁরা যেতে চান আগরতলায়। ওইসময় আরো কয়েকজন বাংলাদেশি আগরতলা যাওয়ার জন্যে গাড়িতে উঠে অপেক্ষা করছিলেন। কংগ্রেস নেতা ওই গাড়িতে তুলে দেন মাসুক এলাহী ও সঙ্গিদের। গাড়িতে ২২ জন। সবাই বাংলাদেশি বিশেষ করে সিলেটের। কেউ কেউ পরিচিত। আগরতলায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখান থেকে তাঁদেরকে হেলিকপ্টারে করে অন্যত্র পাঠানোর আয়োজন শুরু হয়। দৈত্য আকারের হেলিকপ্টার। তিনটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত। প্রতিটি হেলিকপ্টারে পাঁচ শতাধিক ইয়ুথ বাঙালিকে তোলা হয়। এর একটি হেলিকপ্টারে উঠেন মাসুক এলাহী ও সঙ্গিরা। গহীন জঙ্গলে নিয়ে তাঁদের নামিয়ে দেয়া হয়। চারদিকে হিংস্র প্রাণী। হেঁটে কিছুটা পথ যাওয়ার পর চোখে পড়ে একটি বিমানবন্দর। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আরেকটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসেন মেজর সিআর দত্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটি হেলিকপ্টার আসে। ওই হেলিকপ্টার থেকে হেভি আগ্নেয়াস্ত্র নামানো হয়। চারদিকে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র স্থাপন করা হয়। এর পরপরই চারটি ফায়ার করা হয়। বিকট শব্দ। চারদিক কেঁপে উঠে। আশপাশের হিংস্র প্রাণী পালাতে থাকে। এলাকাটি মুক্ত হয় হিংস্র প্রাণী থেকে। এই জায়গাটির নাম ইন্দ্রনগর।