ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কিডনি জটিলতায় বেশি ভুগছেন ট্রাফিক পুলিশেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২১ অক্টোবর ২০২১ ১২:৪০:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

উচ্চ শব্দদূষণে ঘুমের ভেতর কানে বাজে গাড়ির হর্ন। শ্বাসতন্ত্রে সারাবছর জমতে থাকে বিষাক্ত বাতাসের মারাত্মক ক্ষতিকর ধুলিকণা। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দীর্ঘ সময় সড়কে দাঁড়িয়ে থাকায় নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি ট্রাফিক পুলিশের নিত্যদিনের সঙ্গী। উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়বেটিসের কারণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বাড়ছে কিডনিজনিত নানা জটিলতা। এছাড়া সময়মত পানি পান করতে না পারা এবং ওয়াশরুমের সংকটের কারণেই কিডনিজনিত সমস্যার মাত্রা বেশি হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। 

 

উন্নত চিকিৎসায় ভারত যাচ্ছেন অনেকেই 

সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালের নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস বিভাগে মৃত্যুর দিন গুনছেন ট্রাফিক পুলিশের এটিএস মোহাম্মদ মাজেদুর রহমান। এই বিভাগে শুরু থেকেই ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন এটিএস মোহাম্মদ মাজেদুর রহমান। কিডনির সমস্যা মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে বুঝতে পেরে তিনি উন্নত চিকিৎসার আশায় যান ভারতের ভেলোরে। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাজেদুরের কিডনী আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। মাজেদ ট্রাফিক পুলিশে দীর্ঘ সময় কাজ করতেন৷ রাস্তার ধুলোবালি, উচ্চশব্দ আর বিষাক্ত বাতাসের কারণে প্রথমে ধরা পরে উচ্চরক্তচাপ তার কিছুদিন পর শারীরিক অসামঞ্জস্যতা টের পেয়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলে কিডনি সমস্যার কথা জানতে পারেন। গত পনেরো বছর ধরে তিনি ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। মাজেদ পুলিশের চাকরিতে যোগদান করেছিলেন ১৯৯৭ সালে।

নেফ্রোলজি বিভাগেই কিডনির সমস্যায় দুই বছর ধরে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন মোহাম্মদ রফিক। চার বছর আগে জানতে পারেন তার কিডনির সমস্যার কথা। তিনি সর্বশেষ কাজ করছিলেন মতিঝিল ট্রাফিক বিভাগে। সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে ডায়ালাইসিসরত রফিকের ভাষায়, ' পাওটা ফুইলে গেল, ইনস্পেকটর স্যার আমাকে বইললো তোমার পা ফুইলে গেলো কেন? আমি বললাম কি জানি স্যার, আমার এই অবস্থা। স্যার ডাক্তারের কাছে পাঠাইলো। ডাক্তার আমার কাগজ পাতি দেইখা কইলো দ্রুত এই রিপোর্টগুলো কইরে নিয়া আসো। রিপোর্ট কইরা নিয়া আইসলে ডক্তার কইলো তোমার ডায়ালাইসিস নিতে হবে'

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারিবিভাগে ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন। সম্প্রতি কিডনিজনিত সমস্যা নিয়ে সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে এসেছেন। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে শাহাদাৎ হোসেন (৮ সেপ্টেম্বর ২০২১) জানান, ট্রাফিক পুলিশে কাজ করি। আমার কিডনির সমস্যা হইছে। আমার প্রসাবে জ্বালাপোড়া হয়, পুরুষাঙ্গে ব্যথা হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কোমড়ের নিচ থেকে পা পর্যন্ত ব্যথা করে। ডাক্তার বললো চিকিৎসা নিতে।

 

দুই বছর আগে চালু হয় ডায়ালাইসিস বিভাগ

বাংলাদেশ পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে কিডনিজনিত সমস্যা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে প্রায় দুইবছর আগে চালু হয়েছে নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস বিভাগ। এই বিভাগে বর্তমানে ১১টি বেডে ৪৩ জন কিডনি রোগী পালাক্রমে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন (১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী)। হাসপাতালটিতে নতুন করে আরও ১৮টি বেড যুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে। এই বিভাগে ২০২০ সালে পুলিশ সদস্য এবং তাদের স্বজন মিলে কিডনিজনিত রোগের ডায়ালাইসিস নিয়েছেন ৪ হাজার ৬৭৬ জন। ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সংখ্যা ৩ হাজার ৬৫৯জন তবে শুধুমাত্র ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত সদস্যদের কিডনিজনিত রোগীর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা অনেক চেষ্টার পরেও জানা সম্ভব হয়নি। আবার পুলিশের মাঝে আর্থিকভাবে অবস্থাসম্পন্ন যারা তারা এই হাসপালে চিকিৎসা নিতে আসেন না। আবার এই বিভাগ চালু হয়েছে মাত্র দুই বছর হয়েছে। অনেক তথ্য সঠিকভাবে সুনির্দিষ্ট করা নেই সেখানে। কিডনিজনিত সমস্যা আক্রান্ত ট্রাফিক পুলিশের সঠিক পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা না গেলেও মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে ট্রাফিক পুলিশে কিডনিজনিত সমস্যা বাড়ছে আশংকাজনক হারে।

পেশাগত কারনে এমনটা হচ্ছে

সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস বিভাগটি চালু হওয়ার পর থেকেই বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বে আছেন ডাক্তার মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেইন। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, পেশাগত কারণে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজের কারণে পুলিশ সদস্যদের কিডনিজনিত সমস্যা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে৷ বহির্বিভাগে আমাদের এইখানে প্রতিদিন প্রায় দেড়শ এবাং এই বিভাগে ৩০-৩৫ জন কিডনি রোগীর চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের কারও কারও ডায়ালাইসিস লাগে, কারও লাগে না। পালাক্রমে ৬০ জন কিডনি রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছি আমরা।

সময়মত ওয়াশরুমে না যাওয়ায় কিডনীর সমস্যা বাড়ছে

পরিকল্পনাহীন নগরায়নে উদ্ভূত ট্রফিক বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের জীবন স্বস্থ্যের শৃঙ্খলা। ওয়াশরুমের স্বল্পতা কিংবা দীর্ঘ জ্যামের কারণে চাইলেও সময় মতো প্রসাব সারতে পারে না অধিকাংশ ট্রাফিক পুলিশ। চেপে রাখা প্রসাবের কারণেই হয়তো বাড়ছে কিডনীজনিত জটিলতা উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপির) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার(ট্রাফিক) মোঃ মুবিনুর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, রাজধানীর রাস্তাঘাটে প্রেসার অনেক সময় বেশি থাকে। দেখা যায় যে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের নিজেদের স্বাস্থ্যগতদিকটা অনেকসময় উপেক্ষিত থাকে। আবার ট্রাফিক পুলিশরা খোলা জায়গায় কাজ করে, খোলা জায়গায় পানির তৃষ্ণাটা অনেক বেশি হয়। গরমের কারণে তাদের বডি যে পানিটা ডিসার্ভ করে বা ডিমান্ড করে ট্রাফিক চাপের কারণে সেটা পান করতে পারে না। নিয়মিত পানি পান না করাতো ভাল না। অনেকেই লম্বা সময় ইউরিন চেপে রাখে। অতিরিক্ত চাপে অনেক সময় নিজেদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে পারে না। সবকিছু মিলায়ে তাদের শরীরের উপর চাপটা একটু বেশীই পরে। যেটা অনেকের শরীর সহ্য করতে পারে না। যে কারণে অনেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে যায়।

৩২ ট্রাফিক বক্সে ৮ টিতে রয়েছে ওয়াশরুম

রাজধানীর মহাখালি, গুলশান ও বাড্ডা ট্রাফিক জোন মিলে মোট ৩২টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স রয়েছে যেখানে ৮টি বক্সের সাথে সংযুক্ত আছে ওয়াশরুম। বাকী পুলিশ বক্সের দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদদ্যরা ব্যবহার করেন নিকঠস্থ শপিংমল, মার্কেট কিংবা অপরিচ্ছন্ন পাবলিক টয়লেট। রাজধানীসহ বাংলাদেশের সব ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সার্বিক চিত্র প্রায় একইরকম।জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ হাসপাতাল জার্নাল অব মেডিকেল সাইন্সেসের প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক ডা রুবায়ুল মোর্শেদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, আমরা যে স্টাডিটা করলাম তাতে সবার অসুখ কিন্তু এক না। পুলিশের আইজি থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মনে করেন যারা বিসিএস ক্যাডার আর যারা রাস্তায় কাজ করেন ট্রাফিক পুলিশ তাদের অসুখ কিন্তু এক না। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ডাইবিটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রেস এবং ঘুমর সমস্যা মানে ইনসোমনিয়া এইগুলা আর যারা মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের ফুসফুসের সমস্যা, কিডনির সমস্যা, চোখের এবং কানের সমস্যা প্রধান আবার নারী পুলিশ যারা তাদের কিডনি সমস্যা, চোখ ও কানের সমস্যা এবং তাদেরও ফুসফুসের সমস্যা প্রধান।

তিনি আরও বলেন তারা যদি ভাল না থাকে তবে আমাদের সেবা দিবে কি করে। আমরা কতোটা নির্দয়, আমরা তাদের কথা ভাবি না। আমরা আশা করি তারা আমাদের রাস্তায় সহযোগিতা করবে তাদের দেখাশোনা কে করবে।

৮৪ শতাংশ পুলিশ শ্বাসকষ্টে ভোগেন

police-1

মাঠপর্যায়ের কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের ৮৪ শতাংশ শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন। ট্রাফিক এয়ার পলিউশন এন্ড রেসপিরেটরি  হেলথঃ এ ক্রস সেকশনাল স্টাডি এমাং ট্রাফিক পুলিশ ইন ঢাকা সিটি বিষয়ক এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে। শারীরিক ও মানসিক একাধিক স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি সঠিক সময়ে স্বাস্থসম্মত শৌচাগার ব্যবহার করতে না পারাই কিডনীজনিত সমস্যার মূল কারণ বলে ধারণা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার। এছাড়া শৌচাগারের অপর্যাপ্ততার কারণে নারী ট্রাফিক পুলিশের বাড়তি ভোগান্তি সামাল দিতে হয় আছে আমজনতার দৃষ্টিকটু অসহযোগিতার মনোভাবও। রাজারবাগ ট্রাফিক পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত ট্রাফিক মহিলা সার্জন লায়লী আক্তার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, পারিবারিক সকল কাজকর্ম সেরে দুইটা থেকে রাত দশটা ডিউটি করার সময় আমাদের প্রধান সমস্যা বাথরুমের। বাথরুম কাছাকাছি থাকলে সেখানে যাই না থাকলে পানি কম খাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে ক্ষোভের সাথে জানান, হাটুতে ব্যথা, কোমড় ব্যথা, কানে সমস্যা চোখে সমস্যা অধিকাংশ ট্রাফিক পুলশের একটা স্বাভাবিক বিষয়। আমরা এই দায়িত্ব নিয়েছি আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে রাস্তাতেই। তিনি আরও বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন পনেরো থেকে বিশ বছরের উর্ধ্বে সত্তুর শতাংশ  ট্রাফিকের হার্টে সার্জারি আছে। এইভাবে কাজ করা যায় না।