ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চসিকের নতুন স্থাপনা নির্মানের চুক্তিতে নাগরিকের স্বস্থিময় সবুজ সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাবে বিপ্লব উদ্যান

কাজী হুমায়ুন কবির | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:১১:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চট্টগ্রামে কর্মব্যস্ত নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত পরিসর ও উদ্যানের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এ অবস্থায় যেখানে নগরের নাগরিকদেও জন্য সাময়িক অবসর সময় কাটানোতে উন্মুক্ত ও উদ্যান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, সেখানে চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানটি তার সবুজে, ফুলে সৌন্দর্যের শরীরী লাবন্য হারিয়ে ম্লান হয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে গড়ে উঠা চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম দুই নম্বর গেটে গাছগাছালিতে ভরা ছিল বিপ্লব উদ্যানটি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ২০১৮ সালের পহেলা নভেম্বর ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে ২০টি খাবারের দোকান করে নগরবাসীর স্বস্তির ছোট উদ্যানটিকে খাটো করা ফেলে। এর ফলে বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ও উন্মুক্ত পরিসরের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছিল। সেসময়  নগরবাসীর আপত্তি পাত্তা দেয়নি চসিক। ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না। বর্তমানে সেখানে কংক্রিটের অবকাঠামো আছে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। দোকানসহ তার পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। সবুজ আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সবুজ অংশের ভিতর রয়েছে কিছু বড় গাছ এবং কিছু আর্টিফিসিয়াল গাছ ও ঘাস। এখন নতুন চুক্তি অনুযায়ী সেটাও হারাবে দীর্ঘদিনের এই উদ্যানটি। উদ্যানের পূর্ব পাশে দোতলায় ২০০ ফুট দীর্ঘ স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। সেখানে হবে কফিশপ। তার একটি অংশে দোতলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত জাদুঘরসহ প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে। চুক্তি অনুযায়ী, উদ্যানে স্থাপন করা যাবে বিলবোর্ড। আয়োজন করা যাবে মেলা বা উৎসব। রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এসব কাজ করার অনুমতি দিয়ে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে চুক্তি করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এই চুক্তির মাধ্যমে উদ্যানটি যেন তার উদ্যান নাম হারিয়ে ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হবে।

ইতোমধ্যে নির্মাণকাজ করতে গিয়ে উদ্যানে প্রবেশের মূল পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে বড় বড় ব্যানার টানিয়ে উদ্যানের চারপাশ ঘেরাও করা হয়েছে। ভিতরের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ভরাট করা হয়েছে পানির ফোয়ারা। ভেঙে ফেলা হয়েছে গ্যাস টাওয়ারও। অথচ উদ্যানটিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ না করার এবং পুরোনো স্থাপনা অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল নাগরিক সমাজ, নগরপরিকল্পনাবিদ ও বিভিন্ন সংগঠন। ‘সবুজ ধ্বংস করে নতুন স্থাপনা আর নয়’ লেখা একটি ব্যানার টানানো হয়েছে উদ্যানে। নগরবাসীর পক্ষ থেকে এ ব্যানার লাগানো হয়েছে। কিন্তু সবার আপত্তি উপেক্ষা করে উদ্যানে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে অনড় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। উদ্যানের পরিবেশ রক্ষায় নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের প্রক্রিয়া স্থগিত করার দাবি জানিয়েছেন নগরপরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। নতুন চুক্তির পর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে উদ্যানে অবকাঠামো নির্মাণপ্রক্রিয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন উদ্যানের দোকানিরা।

জানা যায়,  ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছিল রিফার্ম ও স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পাঁচ বছরের মধ্যে পুরোনো চুক্তি সংশোধন করে নতুনভাবে করা হয়। আগের চুক্তি ২০৩৮ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা হবে ২০৪৮ সালে; অর্থাৎ সংশোধনের সুযোগে ১০ বছর বাড়তি সময় পাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য এবারের চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড। শুধু চলতি বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধন ও বিনিয়োগ নিয়ে রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২৫ বছরের চুক্তি হয় সিটি করপোরেশনের।

এদিকে আগের চুক্তিতে উদ্যানের পূর্বপাশের নিচতলায় দোকান করা হয়। ওপরে দোতলা করে একই ধরনের দোকান করার কথা ছিল। কিন্তু চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে দোতলার স্থাপনা ভেঙে দিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। ওই সময় উদ্যানে স্থাপন করা বসার আসনের একটি সারিও অপসারণ করা হয়েছিল। নতুন চুক্তিতে ভেঙে দেওয়া দোতলায় আবার স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। দোতলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত জাদুঘরসহ প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে। বিলবোর্ড, মেগাসাইন, এটিএম বুথ, কিয়স্ক, প্রদর্শনী কেন্দ্র কিডস এক্সপেরিয়েন্স বা গেমিং জোন ইত্যাদি স্থাপন করতে পারবে। শুধু তাই নয়, খোরশেদ আলমের সময় বসার একটি সারি অপসারণ করা হয়েছিল। উন্মুক্ত স্থানটিতে এখন ২০০ ফুট দীর্ঘ ও ৫০ ফুট গ্রন্থের কাঠামো নির্মাণ করা হবে। এটি স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হবে। এই স্থাপনা পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের লোগো প্রদর্শন করতে নির্মাণের সুযোগে কাঠামোর ওপর, নিচ ও দুই পাশে পারবে। 

বিপ্লব উদ্যান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হুমায়ূন কবির বলেন, ‘চট্টগ্রামে এমনিতেই উদ্যান ও সবুজের পরিমাণ কম। আবার নতুন করে কোনো স্থাপনা হলে উদ্যানটি তার স্বকিয়তা হারিয়ে ফেলবে।সে জন্য মেয়রের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও দাবী জানিয়েছে। কিন্তু মেয়র অবকাঠামো নির্মাণে অনড়। ওনাকে (মেয়র) বলেছি, প্রয়োজন হলে আমাদের দোকানগুলো ভেঙে ফেলেন, তবু সবুজ রক্ষা করেন। এখানে নতুন নতুন স্থাপনা হলে এটি আর উদ্যান থাকবে না, বাজারে পরিণত হবে।’

বিপ্লব উদ্যানে নতুন স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল বলেন, যেখানে নগরবাসীর উন্মুক্ত পরিসর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, সেখানে সিটি করপোরেশন বিদ্যমান উদ্যানগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করছে। বারবার অনুরোধ করলেও তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। এভাবে উদ্যানে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণে গভীর উদ্বেগের বিষয়। তাই অবিলম্বে কাজ স্থগিত রেখে বিপ্লব উদ্যান যেন নাগরিকদের উদ্যান হয়, সে ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে।