প্রায় এক হাজার ৪৬৩ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা শহর। এখানে বাস করেন নানা শ্রেণি ও পেশার প্রায় দুই কোটি মানুষ। ‘স্বপ্ন গড়ার’ এই ভূমিতে প্রতিদিনই মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। রাজধানীতে বসবাসরতদের নাগরিকসেবা নিশ্চিতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে দুই সিটি করপোরেশন।
নাগরিকদের প্রত্যাশা, তাদের পাওয়া ও না পাওয়া— এসব নিয়েই ২০২১ সাল পার করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রতিষ্ঠান দুটির কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আনন্দের পাশাপাশি না পাওয়ার হতাশাও রয়েছে নগরবাসীর মধ্যে।
বর্ষায় ভুগিয়েছে জলাবদ্ধতা
অন্যান্য বছরের মতো গত বর্ষায়ও জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। বৃষ্টি হলেই নগরের বিভিন্ন স্থানে কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানির চিত্র দেখা গেছে। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি জলাবদ্ধতা নিরসনের আশাও দেখিয়েছিল। নগরবাসী ভেবেছিল, এবার মনে হয় জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে।
কিন্তু কথা রাখতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর পেছনের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠান দুটি বলছে, খালগুলো অবৈধ দখলে রয়েছে। পানির প্রবাহ ঠিক নেই। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে আরও সময় লাগবে। আগামীতে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসবে— দাবি দুই সিটি করপোরেশনের।
খাল নিয়ে নানা পরিকল্পনা
ওয়াসার কাছ থেকে সব নালা ও খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর নানা পরিকল্পনা হাতে নেয় দুই সিটি করপোরেশন। চলতি বছরের (২০২১ সাল) শুরু থেকেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠান দুটি। খালের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তোলা স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। খালগুলোর শাখা-প্রশাখা, বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমও চলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি থেকে জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগরের খালসহ এর শাখা-প্রশাখা এবং পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়। এসব খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে এখন পর্যন্ত এক লাখ তিন হাজার ৫০০ টনের বেশি বর্জ্য এবং ছয় লাখ ৭৯ হাজার টন পলি অপসারণ করা হয়েছে।
ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া অচল দুটি পাম্প স্টেশনের তিনটি মেশিন সচল করতে ইতোমধ্যে সক্ষম হয়েছে ডিএসসিসি। বাকি তিনটি সচলের চেষ্টা চলছে। বছরজুড়ে বদ্ধ ও উন্মুক্ত নর্দমাগুলো পরিষ্কারের কাজ চলমান। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা কর্তারা বলছেন, এসব কাজ শেষ হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতা সহনীয় মাত্রায় আনা যাবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে এখন পর্যন্ত খাল থেকে ১১ হাজার ৬৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। খালের তলদেশ থেকে অপসারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০ টন কঠিন বর্জ্য। বর্তমানে খালগুলোর পানি প্রবাহ সচল রয়েছে। পানির প্রবাহ আরও বাড়াতে কাজ চলছে। মোট ২১ হাজার ৮৪৩ পরিচ্ছন্নতাকর্মী খাল পরিষ্কারের কাজ করেছেন।
এছাড়া, ঢাকা ওয়াসা থেকে পাওয়া ১৮০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজের মধ্যে ৯৪ দশমিক ৭১ কিলোমিটার পরিষ্কারের জন্য ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ এয়ারপোর্ট রোডের বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ ও পাইপলাইন স্থাপন করেছে ডিএনসিসি।
প্রতিষ্ঠানটি ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, আব্দুল্লাহপুর খিজির খালের ওপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ তা দখলে নিয়েছে। তবে আরও কাজ বাকি রয়েছে।
দুই সিটির উচ্চাভিলাষী বাজেটের কাজের অগ্রগতি
২০২০-২১ অর্থবছরে ছয় হাজার ৭৩১ কোটি ৫২ লাখ টাকার উন্নয়ন বাজেট ঘোষণা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অর্থবছর শেষে এক হাজার ৭৭৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাস্তবায়নের হার সাড়ে ২৯ শতাংশ।
একই অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন চার হাজার ৫০৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে দুই হাজার ৮৩৩ কোটি ৩২ লাখ টাকার কাজ। এ বিষয়ে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ না পাওয়া।
নগরবাসীকে ভুগিয়েছে ডেঙ্গু
প্রতি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় নগরবাসী ডেঙ্গুতে নাকাল হন। হিমশিম খেতে হয় সিটি করপোরেশনকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নগরবাসীর দাবি, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন বছরজুড়ে সুদূরপ্রসারী কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না। মশক নিধন কর্মীদের ঠিক মতো কাজ করতে দেখা যায় না। এ কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে।
চলতি বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে কাজ করলেও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাননি নগরবাসী। পুরো মৌসুমজুড়ে বাড়ি-বাড়ি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছে সংস্থা দুটি। যেসব স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, সেসব স্থাপনার মালিকদের মোটা অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হয়েছে।
কিন্তু এডিস মশার কাছে সব প্রচেষ্টাই যেন ব্যর্থ হয়ে যায়। কমানো যায়নি ডেঙ্গুর প্রকোপ। সারাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের গত ২২ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৮ হাজার ২৯৯ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৮ হাজার ৮১ জন। ডেঙ্গুতে এ সময়ে ১০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বাজেটে মশক নিধনে বরাদ্দ কমিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় আট কোটি টাকা কমিয়ে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে। গত অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৩ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে রাখা হয় ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যয় ধরে ৭০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ছিল ৪৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে রাখা হয় ৫৮ কোটি টাকা।
উত্তরের নতুন ওয়ার্ডগুলোতে উন্নয়নকাজ শুরুর উদ্যোগ
সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরও উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত ছিল ঢাকা উত্তরের নতুন ওয়ার্ডগুলো। কিন্তু চলতি বছরের শেষে এসে অর্থাৎ ডিসেম্বরে উন্নয়নকাজ শুরুর ঘোষণা দেয় ডিএনসিসি। দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেগা প্রকল্পের আওতায় নতুন ওয়ার্ডগুলোতে শুরু হচ্ছে উন্নয়নকাজ।
ডিএনসিসির নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নকাজের জন্য গত বছরের ১৪ জুলাই চার হাজার ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে এতদিন তা শুরু করা যায়নি। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, কাজও শুরু হচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ২৮ হাজার ২৯৯ ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হন- স্বাস্থ্য অধিদফতর
২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটিতে (নিকার) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আটটি করে ইউনিয়ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরের বছর এসব ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ৩৬টি ওয়ার্ডকে দশটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে যুক্ত হচ্ছে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ১১তম। এর প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ জন। বিশাল এ জনসংখ্যার শহরে নাগরিকসেবা নিশ্চিত করা দুই সিটি কর্তৃপক্ষের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান দুটি।