ঢাকা, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ৩১ কিলোমিটারে ৫ বছরে ঝরেছে ২৪৯ তাজা প্রাণ

হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৫ জানুয়ারী ২০২২ ০৪:৩৩:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

মহাসড়ক নয় যেনো মৃত্যুকুপ। ঢাকা-টাঙ্গাইল ও বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। থামছে না পরিবারের কান্না। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। টাঙ্গাইলের করটিয়া থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার মহাসড়কে বিগত (২০১৭-২০২১) ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ৫ বছরে ২৪৯ জনের প্রাণহানী এবং ২৪৫ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৬ জন এবং আহত ৫৪ জন। তবে সমীক্ষায় না আসা মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক। দায় কার ? অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষের নমনীয়তাকে দায়ি করছে সুশীল সমাজ। এদিকে উঠতি বয়সী চালকদের বেপরোয়া গতি এবং সড়কে ডিভাইডার না থাকায় এতো প্রাণহানী হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার (ওসি) সফিকুল ইসলাম বলেন, সেতুর পূর্ব প্রাপ্ত থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার মহাসড়ক আমাদের দায়িত্বে। বিগত ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭৪ টি দুর্ঘটনায় ১৩৫ জন নিহত এবং ১৩৯ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ এবং আহত ৩১ জন। মহাসড়কের ডিভাইডার নেই। অন্যদিকে যানবাহনের বেপরোয়া গতি। বিশেষ করে উঠতি বয়সী অদক্ষ ছেলেরা যেভাবে মোটরসাইকেল চালায় সেটা নিয়ন্ত্রণহীন। 

মধুপুর (এলেঙ্গা) হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইয়াসির আরাফাত বলেন, এলেঙ্গা থেকে করটিয়ার মাদারজানী ব্রীজ পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার মহাসড়ক আমাদের অধীনে। গত ৫ বছরে এ সড়কে ১০৩টি দুর্ঘটনায় ১১৪ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে মোটরসাইকেলে নিহত ২৩ এবং আহত ২০ জন। তিনি আরো বলেন, হেলমেট না পড়ার কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘনায় মৃত্যু বেশি। এছাড়া মামলা হলেও বেপরোয়া চালকদের শাস্তি না হওয়া দুর্ঘটনাকে উৎসাহিত করে। 

এদিকে টাঙ্গাইল পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের তথ্যমতে জেলার ১২টি উপজেলায় বিগত ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৯ জন নিহত এবং ৪১৬ জন আহত হয়েছেন (বঙ্গবন্ধু পূর্ব ও হাইওয়ে থানাসহ)। মামলা হয়েছে ৩৭২ টি। তবে মামলা পর্যন্ত যাবার আগেই অনেক নিহত ও আহতের ঘটনা মীমাংসা হয়ে যায়। নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া ঘাটাইলের ধলাপাড়ার আবু বকর, সাঈম ও শরিফ ৩ বন্ধু মিলে ঘুরতে বের হয় মোটরসাইকেল নিয়ে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লেগে ৩ জনই মারা যায় গত ৮ নভেম্বর। এরপর ১২ নভেম্বর ভূঞাপুরের গোবিন্দাসীর শ্রমিক আসাদুল মিয়া (১৫), রাকিব হোসেন (১৬) ও মকবুল হোসেন (১৬) তিন বন্ধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান। মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে ৬ নাবালকের করুণ মৃত্যু এলাকায় শোকের ছায়া নামে।

কালিহাতী উপজেলার নগরবাড়ী গ্রামের আব্দুল হালিম প্রামাণিক বলেন, আমার ছেলে রিফাত ও দুই বন্ধু ইমরুল এবং সবুজ মিলে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে রিফাত ও ইমরুল ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তাদের চেহারা চেনার উপায় ছিল না। ছেলে হারানোর যে কি কষ্ট সেটা আমিই জানি। বেঁেচ যাওয়া আহত সবুজ বলে আমি ডানপায়ে শক্তি পাই না। মোটরসাইকেলের জন্যই আমাদের এ করুণ পরিণতি হয়েছে। মোটরসাইকেল বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ভূঞাপুর টিভিএস পয়েন্টের সত্ত্বাধিকারী সবুজ মিয়া বলেন, অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলেরা অভিভাবকদের চাপে ফেলে মোটর সাইকেল কিনে দিতে বাধ্য করে। কিনে না দিলে তারা আত্মহত্যার হুমকি দেয় এবং বাড়ি ঘর ভাঙচুর করে। এমন অনেক ঘটনা আমাদের জানা আছে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল ঝান্ডা চাকলাদার বলেন, এ মহাসড়কের বাঁক ও ঘন কুয়াশা থাকে। চলাচলকারী উত্তরবঙ্গের বাস ট্রাক এবং উঠতি বয়সী মোটরসাইকেল চালকরা পুরো সড়ককে তাদের নিজের মনে করে চলে। ফলে দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই হয় এবং হবেই। 

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমান একাধিক পথচারী বলেন, ওরা হুন্ডা নিয়ে এতে স্পিরিটে একেবেঁকে যায়, দেখার পর সড়কে চলাচল করতে আমাদেরই ভয় করে।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) টাঙ্গাইল অফিসের দায়িত্বরত সহকারী পরিচালক আলতাব হোসেন বলেন, পথচারীদের অসচেতনতা ও চালকদের ওভারটেকিং প্রবণতাই দুর্ঘটনার মূল কারণ। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরাই বুঝেন তাদের কত কষ্ট।

টাঙ্গাইলের সরকারি মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের অধ্যক্ষ শহীদুজ্জামান মিয়া বলেন, মৃত্যুর এ পরিসংখ্যান ভয়াবহ। তারা আমাদেরই ভাই আত্মীয়-স্বজন। উঠতি বয়সের ছেলেদের মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া মানেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। এর প্রথম দায় অভিভাবকদেরই। দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক আইন যথাযথ কার্যকর করা দরকার। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে। অভিভাবকসহ সকলকে সচেতন হতেই হবে।

টাঙ্গাইলের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রাণহানী রোধে প্রথমে বেপরোয়া উঠতি বয়সীদের ছেলেদের মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাদের মোডিভেশন দিতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালক ও যানের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলে। তবে আমাদের লোকবল সংকট এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে।