ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

টিকিটহীন যাত্রীরা রেলমন্ত্রীর ‘শ্বশুরকূলের আত্মীয়’ !

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : শনিবার ৭ মে ২০২২ ১০:২১:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বৃহস্পতিবার রাতে (৫ মে) পাবনার ঈশ্বরদী রেল জংশন থেকে টিকিট ছাড়া ট্রেনে ওঠেন ৩ যাত্রী। বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের অভিযোগে তাদের জরিমানা করেন টিটিই। এর কিছুক্ষণ পরপরই সেই টিটিইকে বরখাস্ত করা হয়।

 

 

এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দাবি করেন, বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রীরা তার আত্মীয় নয়। তবে আমাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র।

 

শনিবার (৭ মে) সকালে মোবাইলে রেলমন্ত্রী  বলেন, বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রীরা আমার আত্মীয় নয়; ওদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

 

এ ঘটনার কিছুই তিনি জানতেন না দাবি করে মন্ত্রী আরও বলেন, ঘটনাটি তিনি শুনেছেন শনিবার সকালেই। তিনি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনেছেন ওই টিটিই বিনা টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

 

মন্ত্রী বলেন, রেলের অফিশিয়াল কার্যক্রমের সঙ্গে মন্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। ঘটনার সঙ্গে তার কোনো আত্মীয় জড়িত নন। টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না।

 

রেলমন্ত্রী বলেন, বিনা টিকিটের যাত্রী যদি আমার আত্মীয়ও হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। একইভাবে কোনো রেল কর্মকর্তাও যদি যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন তাকেও শাস্তি পেতে হবে। যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার কারণে টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রীর আত্মীয়ের নাম জড়িয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে তা মিথ্যা বলেও দাবি করেন নুরুল ইসলাম সুজন।

 

এদিকে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেওয়া ইমরুল কায়েস (প্রান্ত) লিখিত অভিযোগে করেন, তিনি টেক্সটাইলে চাকরি করেন। সুন্দরবন ট্রেনে তাড়াহুড়ো করে উঠেছিলেন। এজন্য টিকিট কাটতে পারেননি। পরে টিটিই শফিরুল ইসলাম তার কাছে বেশি টাকা দাবি করেন। সেটা না দেওয়ায় গালিগালাজ করেন। টিটিই শরিফুল ইসলাম মাদকাসক্ত বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

 

প্রান্তর অভিযোগ এবং রেলমন্ত্রীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান চালায় দৈনিক বায়ান্ন। জানা গেছে, ইমরুল কায়েসের (প্রান্ত) স্থায়ী বাড়ি ভেড়ামারা কুষ্টিয়া। তার বাবার নাম মুজাহেদুল ইসলাম। মুজাহেদুল ইসলাম আবুধাবি প্রবাসী। তার মায়ের নাম ইয়াসমিন আক্তার নীপা। প্রান্তর বাবা আবুধাবী প্রবাসী হওয়ার কারণে ইয়াসমিন আক্তার নীপা ঈশ্বরদীর নূর মহল্লায় বসবাস করেন। প্রান্তর সঙ্গে আরও দুই যাত্রী ওই ট্রেনে ছিলেন তাদের নাম, হাসান ও ওমর। হাসানের বাবার নাম জাহাঙ্গীর আলম। হাসান রাজশাহীতে একটি কলেজে এইচএসসিতে পড়াশোনা করে। ওমরের বাবার নাম আব্দুর রহমান। ওমর পাবনা শহরে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেন। হাসান ও ওমর ইয়াসমিন আক্তার নীপার চাচাতো ভাই।

 

ইয়াসমিন আক্তার নীপার সঙ্গে যোগাযোগ করে দৈনিক বায়ান্ন। নীপা জানান, তিনি রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী শাম্মী আকতার মনির আপন ফুফাতো বোন। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর জন্ম ঈশ্বরদীতে। এখানে তার নানাবাড়ি। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বাবা চাকরি সূত্রে দিনাজপুরের বিরামপুরে থাকতেন। পরবর্তীতে বিরামপুরে স্থায়ী হন। রেলমন্ত্রীর স্ত্রী এ ঈদে ঈশ্বরদীতেই ছিলেন।

 

নীপা আরও দাবি করেন, আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। সে টিকিট কেটেই উঠেছিল। (প্রান্তর অভিযোগপত্রে লেখা আছে কাউন্টারে টিকিট না থাকাই টিকিট না কেটেই ট্রেনে উঠেছে)। এরপরেও টিটিই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। এর আগে আমার ছেলে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেওয়ায় ট্রেনের ফাঁকা কেবিনে তুলে দেয় থাকায় ট্রেনের গার্ড। রেলমন্ত্রী স্ত্রী শাম্মীও ফোনে কেবিনে বসানোর জন্য অনুরোধ করেন।

 

নীপা  বলেন, শাম্মী বলেছে গার্ডকে, ‘আমার বাচ্চারা যাচ্ছে। ভালোভাবে নামাই দিয়েন।’ যখন সুপারিশ যাবে ভিআইপি মানুষের তখন ভালোভাবেই নামায় দেবে। তখন গার্ড দেখে কেবিন খালি আছে তখন কেবিনে নিয়ে গিয়ে বসায়। এদিকে টিটিই এসে ওদের বলে, তোমাদের টিকিট সাধারণ শ্রেণির আর তোমরা এসে বসছো কেবিনে! এটা কি বাপের ট্রেন? তখন টিটিই বলছে, রেলমন্ত্রীর আত্মীয় তো তাতে কী। এ কথা শুনে আমার ছেলের মাথা হ্যাং হয়ে যায়। সে আমাকে ফোন দিয়ে বলে আম্মু আমাদের সঙ্গে এমন করা হচ্ছে। আমার পাশেই শাম্মী ছিল। তখন শাম্মীকে বললাম দেখতো কি বলে। তখন আমার ছেলে তার খালাকে সব খুলে বলে। তখন শাম্মী বলে, কোন টিটিই নাম বল। আর উনার মোবাইল নাম্বার দাও। তখন টিটিই আর মোবাইল নাম্বার দেয়নি। তখন গার্ডকে ফোন দেয় শাম্মী। এরপর ডিসিওকে ফোন দিয়েছে। ডিসিও বলেছে, ম্যাডাম আপনি টেনশন করবেন না। সকাল হলেই আমি ব্যবস্থা নেব। এখন বরখাস্ত হওয়ার পরে এখন টিটিই উল্টো- পাল্টা কথা ছড়াচ্ছে।

 

তিনি আরও বলেন,  এতে উনার ভালো হলো না। উনার খারাপ হয়ে গেল। উনি বরখাস্ত হইছে। এখন উনার চাকরির কী হবে সেটাই চিন্তা করুক।

 

গত বৃহস্পতিবার (৫ মে) রাতে পাবনার ঈশ্বরদী রেল জংশন থেকে টিকিট ছাড়া ট্রেনে ওঠেন ‘রেলপথমন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয়দানকারী ৩ যাত্রী। টিকিট না কাটলেও তারা রেলের এসি কেবিনের সিটে বসেন। এতে রেলের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) তাদের জরিমানা করেন। পরে ওই ৩ যাত্রী তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা হয় বলে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেন।

 

সেই অভিযোগের ভিত্তিতে টিটিই শফিকুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার রাতেই বরখাস্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ। বরখাস্তাদেশ শুক্রবার (৬ মে) থেকে কার্যকর হয়েছে। বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাকশীর ডিসিও (বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা) নাসির উদ্দিন।