ঢাকা, শুক্রবার ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ১৮ই মাঘ ১৪৩১

টেকনাফ স্থলবন্দর থেকেই ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে বদি পরিবার

স.ম ইকবাল বাহার চৌধুরী, কক্সবাজার: | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারী ২০২৫ ১২:৪৪:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে টেকনাফ স্থলবন্দর মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি ছিল। এই মাফিয়া চক্রের প্রধান হোতা হচ্ছে ইয়াবা নিয়ে আলোচিত, সমালোচিত ও বহু বিতর্কিত আওয়ামী লীগের দলীয় সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি। তার একক আধিপত্যেই দীর্ঘ ১৬ বছর পরিচালিত হয় টেকনাফ স্থল বন্দর। আর দলীয় ও পরিবার নিয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছি গত ১৬ বছরে। যার নেতৃত্বে ছিলেন বদির আপন ভাই আব্দুল আমিন, এমনটি জানান নির্যাতিত ব্যবসায়ীরা।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের টেকনাফ স্থল বন্দরকেন্দ্রিক টেকনাফ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের কমিটি দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বহাল রয়েছে। উখিয়া-টেকনাফ থেকে আব্দুর রহমান বদি প্রথম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ২০০৯ সালে বন্দরের আগের কমিটি ভেঙে দিয়ে একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে তার আপন ভাই আবদুল আমিনকে সভাপতি ও এহতেশামুল হক বাহাদুরকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের এই কমিটি গঠন করা হয়।  যা আজও পর্যন্ত বহাল রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালে আত্মস্বীকৃত মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণে এই কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি বদির আপন ভাই আবদুল আমিন ১০২ জন শীর্ষ মাদক কারবারির সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেন। মাদক কারবারি হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার পরও তার সভাপতি পদ বহাল থাকে। ওই সময়  দুই বছর জেল খেটে জামিনে বের হয়ে পুনরায় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বন্দরে অ্যাসোসিয়েশনের নামে চাঁদাবাজি শুরু করেন তিনি। তিন বছর পরপর নির্বাচনের কথা থাকলেও ২০০৯-২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এই ১৬ বছরে আর কোনো নির্বাচন হতে দেখা যায়নি। বদির আশীর্বাদে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করে তার একান্ত আজ্ঞাবাহক  একই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। মূলত আড়াল থেকে বদির নির্দেশে এই কমিটি পরিচালিত হয়। সংগঠনটির আমদানি-রফতানি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় ও বন্দরের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে। সাধারণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নয় বরং বদির প্রয়োজন ও স্বার্থ রক্ষায় চলত এই কমিটি।

দীর্ঘ এই ১৬ বছরে কখনো আমদানি-রফতানিকারকদের স্বার্থে তাদেরকে একটি কথাও বলতে দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে বছরের পর বছর এই বন্দর দিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়েছে যা নিয়ে তারা নীরব ছিল। তাদের মূল কাজ ছিল বন্দরকেন্দ্রিক বদির চাঁদাবাজি, রাজস্ব ফাঁকি, স্কেল-ওজন কারসাজি, শ্রমিক মাঝিদের স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন ধরনের অন্যায় অনিয়মে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা।

বন্দরকেন্দ্রিক এক ব্যবসায়ী নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ২০০৯ সালের আগে বন্দরে শ্রমিকদের একটি বকশিশের রেওয়াজ ছিল যা ট্রাকপ্রতি ৫০০ টাকা। সেই ৫০০ টাকা বর্তমানে ৭ হাজার টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে এই চক্রটি। যা সরাসরি তাদের পকেটে চলে যায়। এ ছাড়াও বছরখানেক আগে এই বন্দরের একটি স্কেল-ওজন কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। গত ১৬ বছর ধরে  ট্রাক স্কেলের ওজন কারাসাজির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনাটিও শতকোটি টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যেটি এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাহাদুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসবে। গত ১৬ বছর টেকনাফ স্থলবন্দর এই মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি ছিল। এই মাফিয়া চক্রের প্রধান হোতা হচ্ছে ইয়াবা নিয়ে আলোচিত বিতর্কিত আবদুর রহমান বদি ও তার পরিবার এবং তাদের খুবই ঘনিষ্ঠরা, যার মধ্যে বাহাদুর উল্লেখযোগ্য।

যে বিশাল  চাঁদাবাজি ও ওজন কারসাজির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা নীরবে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলে আসছে এই বিষয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কখনো বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য করেনি বরং তারা নিজেরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর অংশীদার ছিল। স্বৈরাচারী ভাবে এই কমিটির মাধ্যমেই বদি পরিবার ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে এমন অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। বদির আপন ভাই হওয়ায় আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে ২ বছর জেল কেটেও ১৬ বছর কমিটির সভাপতি হিসাবে বলবত আছে।

উল্লেখ্য যে,২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) বেলা ১১টার দিকে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন। এদের মধ্যে কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাইসহ ৮ স্বজনও রয়েছে।

বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ