দেশজুড়ে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপে নাজেহাল মানুষ। প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে ডেঙ্গুর থাবায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬৩ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৬১২ জন। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বাড়ছে রোগীর চাপ। রোগী সামলাতে হিমশিম অবস্থা রাজধানীর হাসপাতালগুলোয়। ডেঙ্গুতে দিশাহারা হয়ে পড়ছে মানুষ।
রাজধানীতে ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছে ডেঙ্গুজ্বর। জ্বর এলেই টেস্ট করতে হাসপাতালে ছুটছে মানুষ। হাসপাতাল, ক্লিনিকে দীর্ঘ লাইন ডেঙ্গু টেস্টের। গত বৃহস্পতিবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে দেখা যায়, ১০০-এর বেশি মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অধিকাংশেরই গায়ে তীব্র জ্বর। সকাল থেকে টেস্টের জন্য একটানা নমুনা নিয়েই চলছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে ছুটছে। কিন্তু রোগীর চাপে হাসপাতালে শয্যাসংকুলান হচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। শয্যার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ভর্তি সেখানে। মেঝে, বারান্দা থেকে করিডোরে রোগীর ভিড়ে তিলধারণের জায়গা নেই। বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ সামলাতে হিমশিম অবস্থায় রোগী ও স্বজনরা। রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইন, ক্যানোলাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই স্যালাইন উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্যালাইনের দাম বাড়িয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে সরবরাহ সংকট। আগে যে স্যালাইন বিক্রি হতো ৯০ টাকায়, এখন তা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। আবার অনেক জায়গায় স্যালাইন পাওয়াই যাচ্ছে না। আগে ক্যানোলার যে সেটের দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন ১৫০ টাকা। এর সঙ্গে দাম বেড়েছে মাইক্রোপ্রোরও (ক্যানোলা স্থাপনে ব্যবহৃত বিশেষ টেপ)। আগে এক বাক্স মাইক্রোপ্রোর দাম ছিল ৬০০ টাকা, এখন ৮০০ টাকা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় ও পরীক্ষার ফি নির্ধারণে আমরা বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা সময় চেয়েছেন। চিকিৎসার ব্যয় নির্ধারণে কিছু জটিলতা আছে। এটা করতে হলে হাসপাতালগুলোর গ্রেড নির্ধারণ করতে হবে। তবে অধিদফতরের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা এনএস-১ ও আইজিজি-আইজিএম ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিবিসি পরীক্ষার ফি ৪০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ফি নির্ধারণের বিষয়টি শিগগিরই সম্পন্ন করার চেষ্টা চলেছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৮৯৬ জন এবং মারা গেছেন একজন। আক্রান্তের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪০৩ এবং ঢাকার বাইরে ৪৯৩ জন। শুক্রবার হওয়ায় অনেক হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য আসেনি। ২০ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন নয়জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৫৫ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৫ এবং ঢাকার বাইরের ৯১০ জন। ১৯ জুলাই মারা গেছেন ১৯ জন। এক দিনে এত মৃত্যু দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাসে রেকর্ড। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৯২ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৯২২ এবং ঢাকার বাইরের ৮৭০ জন। ১৮ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৩৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৭৯ এবং ঢাকার বাইরের ৭৫৪ জন। ১৭ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৮৯ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৭ এবং ঢাকার বাইরের ৭৪২ জন। ১৬ জুলাই মারা গেছেন ছয়জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪২৪ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৪১ এবং ঢাকার বাইরের ৬৮৩ জন। ১৫ জুলাই মারা গেছেন সাতজন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬২৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ১৬৮ এবং ঢাকার বাইরের ৪৫৫ জন।
এ পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ২৮ হাজার ৪৪৩ জনের মধ্যে ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানো ১৫৬ জনের মধ্যে ৮৯ জন পুরুষ এবং ৬৭ জন নারী। ডেঙ্গু আক্রান্তের বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮-৪০ বছর বয়সী আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৩২৭ জন।
ঢাকার সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১ হাজার ৮৪৮ জন, বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছেন ১ হাজার ৭১২ জন। গতকাল রাজধানী বাদে ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭১০ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ৬২৩, বরিশালে ৫৭৩, ময়মনসিংহে ১৬৫, সিলেটে ৬৮, রাজশাহীতে ৯৩, রংপুরে ৬৬ ও খুলনায় ২১৮ জন।
রোগীর চাপে হাসপাতালগুলোয় হিমশিম অবস্থা। ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুতে রোগীর এরকম চাপ থাকায় ভরা মৌসুমে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা। এ সময় মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারি খাটিয়ে ঘুমানোসহ সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ঘরে ঘরে বাড়ছে আক্রান্ত। জ্বর এলে করণীয় বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘জ্বর এলে দ্রুত ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা নিতে হবে। বেশি বমি, পেটে, মাথায় তীব্র ব্যথাসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে আসতে হবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত পানি, জুস ও তরল খাবার খেতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। শিশু, বয়স্ক এবং অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের বেশি খেয়াল রাখতে হবে। ঘরে এবং চারপাশে পানি জমে থাকলে তা ফেলে দিয়ে মশার বংশবিস্তার রোধ করতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেছেন, ‘একজন কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে মাঠপর্যায়ে দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি শিশুদের মশায় কামড়ানোর ঝুঁকি বেশি। স্ত্রী মশার পেটে যখন ডিম আসে তখন তার প্রধান খাদ্য রক্ত এবং শিশুরা প্রায়ই এ মশার শিকার হয়। মশা কামড়ালে শিশুর ত্বকে কামড়ের প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে দেখা না-ও যেতে পারে। তবে কিছুক্ষণ পর বা কয়েক ঘণ্টা পরও কামড়ের চুলকানি ও ফোলাভাব হয়। অনেক কারণে শিশুদের মশায় কামড়ানোর হার বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের ত্বকের তুলনায় শিশুদের ত্বক নরম এবং কামড়ের জন্য বেশি সংবেদনশীল। নরম ত্বকে সহজেই মশা তার হুল ফুটিয়ে রক্ত গ্রহণ করতে পারে। শিশুরা মশার কামড়কে সহজে বুঝতে পারে না এবং মশা তাড়াতেও পারে না। মশা কামড়ালে শিশুদের প্রতিরোধক্ষমতাও প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দুর্বল। তাই তারা রোগের জন্য বেশি সংবেদনশীল। ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি। তাই মশক নিধনে বছরজুড়ে সমন্বিত কর্মসূচি নিতে হবে।’