রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও। শঙ্কা রয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঘটার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের ওপর প্রভাব’ সংক্রান্ত এ প্রতিবেদন বুধবার (২৭ এপ্রিল) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে রাশিয়ার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়— রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের রাশিয়ার ঋণ চুক্তির অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে আসে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ওই ঋণের অর্থ লেনদেনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—রাশিয়ায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়। বেশকিছু ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন সংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করার ফলে রাশিয়ায় গার্মেন্টস রফতানি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। ফলে যেসকল পোশাকের অর্ডার শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে তার পেমেন্ট রিকভারি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
রাশিয়ার বেশ কিছু ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন সংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করায় কোনও ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পরিশোধ করলে তা হয়তো মাঝপথে আটকে যেতে পারে। এ অর্থ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়- যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়েছে। বাংলাদেশের রফতানির পুরোটাই এফওবি (প্রিন অন বোর্ড) ভিত্তিতে হওয়ার ফলে রফতানি খরচ বাড়বে। আর আমদানির বেশিরভাগই কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট ভিত্তিতে হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে। এতে আমদানি ব্যয় বাড়বে। বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে। চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঘটাতে পারে।
গত নয় বছরের মধ্যে তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠায় প্রতিদিন জ্বালানি তেল বাবদ সরকারকে ১৫ কোটি ডলার লোকসান দিতে হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে। এর প্রভাবে আমাদের পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও খরচ বাড়বে।
রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানিকারী ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কাতার, ওমান, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলির দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে বাংলাদেশের এলএনজির মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
ইউক্রেন সংকটের কারণে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হবে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমে যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ সহ যেসব প্রকল্পের বিষয়ে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মরণ স্বাক্ষরিত রয়েছে সেগুলো দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়তে পারে।
চলতি অর্থ বছরে রাশিয়া থেকে ৪ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। আরও দেড় থেকে দুই টন আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়াও বাংলাদেশে সূর্যমুখী ও তুলাবীজের বড় অংশ রাশিয়া থেকে আসে। রাশিয়া থেকে আমদানিতে অসুবিধা হলে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে বিশ্বে ৩০ শতাংশ গম সরবরাহ করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে গম আমদানির ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল। বাংলাদেশ দেশ দুটি থেকে খুব বেশি গম আমদানি না করলেও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ প্রভাবিত হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এটা মূলত কূটনৈতিক সমস্যা নয়, অর্থনৈতিক সমস্যা। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি দেখছে।