দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে সারা দেশে ৩০০ আসনেই যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীর সন্ধান করা হচ্ছে। একাধিক উপায়ে প্রতিটি আসনে কে বেশি যোগ্য প্রার্থী জানতে ৬০০ জনের মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০০ আসনে জরিপ শেষ হয়েছে। সে পরীক্ষায় যিনি বেশি নম্বর পাবেন তিনিই নৌকা পাবেন। আর বাদ পড়বেন অদক্ষ ও কর্মীবিরোধী এমপি-মন্ত্রীরা।
গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এমন আভাস দিয়েছেন দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বৈঠকে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিবন্ধিত সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য ও চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে ৬০০ জন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিশেষ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং দেশ-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হোক সেটা আমরা চাই। নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক সেটাও চাই। সে জন্য গত শনিবার আওয়ামী লীগের বৈঠকে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্তভাবেই বলেছেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান। এ জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। কোনো জনবিচ্ছিন্ন, কর্মীবান্ধব নয়, এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না।’ তিনি বলেন, ‘অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে নেত্রী খুবই সিরিয়াস। দলের নেতা-কর্মীকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, কাউকে নির্বাচিত করার দায়িত্ব তিনি নেবেন না। প্রার্থীর জনপ্রিয়তা দিয়েই পাস করে আসতে হবে। কাজেই বিতর্কিতরা বাদ পড়বেন, এটা স্বাভাবিক।’
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অংশ হিসেবে ইশতেহার তৈরির নির্দেশনাও দিয়েছেন। ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সংশোধনের কাজও শুরু করা হচ্ছে। তার আগে দলীয় সভানেত্রী নিজস্ব টিম, বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে মাঠ জরিপ করছেন। একই সঙ্গে তৃণমূলকে সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দল গুছিয়ে নতুন উদ্যমে আগামী নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো জয় ছিনিয়ে আনতে চায় দলটি। তাই দলের দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত, অপরাধপ্রবণ, দলীয় কোন্দলে জর্জরিত, পদ-পদবি বিক্রি করা নেতা-এমপি-মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে সৎ ও দক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে দল সাজানো হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় কেন্দ্রীয় কাউন্সিলেও দলের পদে জনপ্রিয় নেতাদের স্থান দেওয়া হচ্ছে।
গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন। সারা দেশে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান এমপি-মন্ত্রীদের আমলনামা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যতবার নির্বাচিত প্রার্থীই হোক, এলাকায় কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, ভর্তি ও বদলি বাণিজ্য কিংবা টিআর-কাবিখার টাকা মেরে খাওয়া কাউকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘যোগ্য, সৎ, জনপ্রিয়, কর্মীবান্ধব, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে সক্ষম, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল এমন ব্যক্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। যারা বিগত দিনে দলের দুর্দিনে নৌকার হাল ধরে খুনি ও ঘাতক চক্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন এমন মানুষকে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেবেন। সেভাবেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে।’ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ‘গডফাদার’ ও ‘জনবিচ্ছিন্ন’ সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেসব এমপির বিরুদ্ধে এলাকায় খুন, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, ঋণখেলাপি, টেন্ডার-চাঁদাবাজিসহ দখলদারিত্বের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তারা কেউ মনোনয়ন পাবেন না। ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের তালিকার কাজ শেষ হয়েছে। জরিপ কাজে জড়িত একাধিক সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব আসনে ফের তাদের মনোনয়ন দেওয়া হলে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অসাধ্য হবে। এসব মন্ত্রী-এমপিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের কারও বিরুদ্ধে এলাকায় জনপ্রিয়তা হ্রাস, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অনেকের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, অনৈতিকভাবে বিত্তবৈভব গড়ার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সন্ত্রাস ও দলীয় কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগ।
দলীয় নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এমনকি বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নিয়েও নিজস্ব বলয় সৃষ্টির অভিযোগও আছে কারও বিরুদ্ধে। আর এসব কারণে প্রার্থী বাছাইয়ে প্রায় দুই বছর সময় নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ক্লিন ইমেজ ও জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আরও আগেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং গত শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা দলকে ঐক্যবদ্ধ ও গুছিয়ে আনার পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবেও প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু করবে খুব শিগগিরই। এলাকাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, এজেন্ট প্রশিক্ষণ, প্রচার নিয়ে কাজ হচ্ছে। মনোনয়নের জন্যও আমরা এখন থেকেই খোঁজখবর রাখছি।’ দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই করা হলেও জোটের কারণে অনেক আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেবে না। সে জন্য জোটকে ছেড়ে দেওয়া হবে। যেখানে জোটের শক্তিশালী প্রার্থী থাকবে সেখানে জোটগত ভোটে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ।