দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোটের শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে চায় রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সবরকম টানাপোড়েন কাটিয়ে জোটের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ চায় দলটি।
একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের লক্ষ্যে সমমনা বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর এক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগও নিয়েছে বিএনপি। আগামী মাসের মধ্যেই তা চূড়ান্ত রূপ পাবে বলেও আশা করছেন দলীয় নীতিনির্ধারকরা। এর মাধ্যমে নিজেদের জোটে দীর্ঘ সময়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিষ্ক্রিয়তা, ভুল বোঝাবুঝি ও টানাপোড়েনসহ সব ধরনের দূরত্ব কমিয়ে বৃহৎ এক রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায় বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বৃহৎ রাজনৈতিক জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চলছে। সমমনা বিরোধীদলগুলোর মধ্যে যারাই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে শরিক হবেন, তারাই এ ঐক্যের অংশীদার হবেন। খুব শিগগিরই দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু হবে। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। জানা গেছে, দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা ও নেতৃত্বাধীন দল বিএনপির অবহেলার কারণে প্রায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোট ও ফ্রন্টের ব্যানারে এখন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হয় না। কোনো কার্যক্রমও নেই তাদের। রাজনীতির ময়দানে নামেমাত্র ধরে রাখা অস্তিত্বটুকুও হারিয়ে ফেলছিল দেশের বৃহৎ এ বিরোধীদলীয় জোট। তবে কৌশলগত কারণে তখন আনুষ্ঠানিকভাবে এ জোট বিলুপ্তির ঘোষণাটুকু দেয়নি বিএনপি। জোটের নেতৃত্বে থাকা প্রধান দল বিএনপির অবমূল্যায়ন, অবহেলা ও অবমাননায় এতদিন শরিকরা ছিল প্রচ ক্ষুব্ধ। বিএনপির ‘একলা চলো নীতি’র কাছে শরিক দলগুলোর আগ্রহ ও উৎসাহে একেবারেই ভাটা পড়েছিল। হতাশার কবলে পড়ে তারা নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল।
বিএনপির নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে গঠিত চারদলীয় জোটের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ২০১২ সালে ১৮-দলীয় জোট এবং পরে আরও দুটি দল নিয়ে ২০-দলীয় জোট গঠন করা হয়। এই জোটের প্রত্যেকটি শরিক দলই কমবেশি ভাঙনের মুখে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ায় বিএনপিও একপর্যায়ে জোট নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল। জোটে থেকেও কোনো কোনো শরিক দলের মূল নেতা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতিও দিয়েছিলেন। এমনকি জোটের ভিতর উপজোট গঠনেরও চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই মূলত জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোসহ রাজনীতিতে মোটামুটি সক্রিয় ডান-বাম ও ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে এনে নতুন জোটের প্রক্রিয়া শুরু করছে বিএনপি। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ গতকাল বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোটের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে এলডিপির সঙ্গে। আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সমর্থন করিনি। কারণ আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আর অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছিল। পরবর্তীতে যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। তাছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপিও একলা চলো নীতি অবলম্বন করে। এখন তারা অনুধাবন করছে যে, এ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ও জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সে লক্ষ্যে বিএনপি এখন বিভিন্ন দল ও নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস (একাংশ), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ন্যাপ, মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম (একাংশ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এডিপি, ইসলামিক পার্টি, ডেমোক্রেটিক লীগ, পিপলস লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), সাম্যবাদী দল এবং জাতীয় দল। বিএনপি ছাড়া এ জোটের প্রায় প্রতিটি দলই দ্বিখি ত হয়েছে। ২০-দলীয় জোটের মধ্যে নিবন্ধিত দল মাত্র ছয়টি। বাকি দলগুলো অনিবন্ধিত। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, নতুন জোটের সম্ভাব্য নাম হতে পারে- ‘সম্মিলিত বিরোধীদলীয় জোট’। সাংগঠনিকভাবে মোটামুটি শক্তিশালী ও সক্রিয় ডান, বামসহ ইসলামী নানা সংগঠন অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে বৃহৎ এ জোটের। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য দল এবং নেতারা এতে থাকবেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য বিএনপিকে অবশ্যই দরকার। এটা যারা মনে করে না, তাদের দিয়ে কখনো সরকারবিরোধী আন্দোলন হবে না। তবে বিএনপির সঙ্গে ‘ফরমাললি’ এখনো এ নিয়ে আমার আলোচনা হয়নি। ‘ইনফরমালি’ যেটুকু হয়েছে, তাতে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এখনো পরিষ্কার নই।
জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, প্রায় দুই বছর ধরেই এই জোট নিষ্ক্রিয় ছিল। এ জোটের সৃষ্টি হয়েছিল বিএনপির আহ্বানে। কাজেই জোটকে সচল করতে হলে বিএনপিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বৃহত্তর রাজনৈতিক জোটের বিষয়ে তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা এখনো পর্যন্ত না হলেও তিনি তা নিয়ে আশাবাদী বলে জানান। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এ প্রসঙ্গে বলেন, শরিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মজবুত করার জন্য ইতিমধ্যে আমরা তাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছি। আমরা সবাইকে নিয়েই জাতীয় ঐক্য গঠন করব। আশা করছি, আগামী মাসের মধ্যে এ ঐক্য চূড়ান্ত রূপ নেবে।