নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। বর্তমানে বাজারে দাম কমার থেকে বাড়ার তালিকাই বেশি। সামনে ঈদুল আজহা। এমন আবহে নিত্যপণ্যের বাজারে একরকম অস্থিরতা শুরু হয়েছে। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বাড়ার এ প্রভাব। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি ব্যবস্থা থাকলেও এর সুফল দেখা যাচ্ছে না বাজারে। কাঁচাবাজারের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। ফলে সাধারণ মানুষ; বিশেষ করে খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাসের উপক্রম। কিছুদিন আগেও ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেপের দাম বেড়ে এখন ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে সবজি কেনাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পণ্যের মূল্য কমার চেয়ে দিন দিন মূল্যবৃদ্ধির তালিকার বহর আরও দীর্ঘ হচ্ছে। পেপে, লাউ, করোলার মতো সবজি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আমিষের উৎস হিসেবে পরিচিত ডিমের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি চিনি কিনতেও ক্রেতাকে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা চিনি বর্তমানে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়।
শুক্রবার (৫ মে) রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মেরাদিয়া হাট, মালিবাগ বাজার, গোড়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার এবং সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে দাম বাড়ার এমন চিত্র দেখা গেছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন।
সরকারি তথ্য মতে, আলু, দেশি ও আমদানি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, দেশি ও আমদানি আদা, জিরা, দারুচিনি, তেজপাতা, চিনি এবং ডিমের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সরু ও মাঝারি চাল, বড় ও ছোট মশুর ডাল, আমদানি করা রসুন, দেশী হলুদ, ধনে এবং ব্রয়লার মুরড়ির মূল্য হ্রাস পেয়েছে।
পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দামও বেড়েছে হুহু করে। প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বেড়ে ১৯৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, পেঁয়াজ, আদা-রসুনের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ দাম বেড়েছে আমদানি করা আদায়, যা বর্তমানে প্রতি কেজি ১৮০-৩২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও আমদানি করা আদার দাম ছিল মাত্র ৭০ থেকে ১২০ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৪৮ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে। সংস্থাটির গত এক বছরের খুচরা বাজারের দামের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসময়ের ব্যবধানে বাজারে ৪৮ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ৩৭টির দাম। কমেছে শুধু ১০টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে শুধুমাত্র ১টি পণ্যের দাম।
এর মধ্যে গত এক বছরে দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে আছে মোটা স্বর্ণা চাল। এ চাল গেল এক বছরে বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে মোটা স্বর্ণা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৬-৫০ টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। আর গত এক বছরে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করেনিয়েছে আমদানি করা আদা। এর দাম গেল এক বছরে বেড়েছে ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাজারে আদার দামে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বর্তমানে প্রতিকেজি আদা ১৮০-৩২০ টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল মাত্র ৭০ টাকা থেকে ১২০ টাকায়। পাশাপাশি সংস্থাটির গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজারে ৪৮ টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে গেল এক মাসে বেড়েছে ১৫টির দাম। কমেছে ৯ টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ২৪টির।
এর মধ্যে গত এক মাসে টিসিবি'র হিসাব অনুযায়ী, দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে অবস্থান গরুর মাংসের। গেল এক মাসে এর মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে গরুর মাংসের দাম ৭৩০-৭৫০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৭০০-৭৫০ টাকা। আর গেল এক মাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে দেশি নতুন রসুন। গেল এক মাসে এর দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশি নতুন রসুনের দাম কেজিপ্রতি ১৩০-১৮০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল মাত্র ৮০ থেকে ১২০ টাকা। বাজারে হঠাৎ দেশি রসুনের দাম বেড়ে যাওয়াতে ক্রেতারা একপ্রকার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
মূলত কোরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের। দাম বাড়ার তালিকায় বাদ যায়নি অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ডিম। এ ছাড়া শিশুখাদ্য হিসেবে ডিমের চাহিদা অনেক। মধ্যবিত্ত পরিবারে মাছ-মাংসের চাহিদা কমিয়ে ডিমের ওপর নির্ভর করলেও এখন সেখানে মূল্যবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে প্রতি হালি (লাল) ডিমের দাম ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সপ্তাহ খানে আগে ১২০-১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিম বর্তমানে এলাকা ভেদে ১৫-২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৮ টাকা পর্যন্ত।
ডিমের বাজার কেন বারবার অস্থিরতা বাড়ছে এবিষয়ে কয়েকজন পল্ট্রি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে ডিমের দাম আরও বাড়বে। মুরগির খাবারে দাম বাড়ায় অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। যার প্রভাব ডিমের বাজারে দেখা দিচ্ছে। লোকসানের কারণে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী লোকসান কমাতে খামারের আকার ছোট করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ডিমের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি হিসেবে, এক বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে খোলা আটা কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৫৫-৫৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পাশাপাশি প্যাকেট আটা ২০ টাকা বেড়ে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো। এখন তা ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। ফলে খেটেখাওয়া মানুষের জীবন চালিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।