করোনা মহামারি সংকটে ধীরগতি দেখা দিয়েছে জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১ প্রকল্পে। তবে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে ট্যাব কেনা নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। এক-দু’বার নয়, তিন লক্ষ ৯৫ হাজার ট্যাব কিনতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রস্তাব চারবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব ট্যাব কেনায় মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৩৭ কোটি ১২ লক্ষ ১০ হাজার ৩৯৫ টাকা। একই কোম্পানির কাছ থেকে ট্যাব কিনতে এর আগে চারবার প্রস্তাব পাঠায় বিবিএস। কিন্তু রাষ্ট্রের জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে এসব ট্যাব কেনার প্রস্তাব বাতিল করেছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। অথচ আর মাত্র চার দিন পরই (২৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর) সারাদেশে জনশুমারি শুরু হওয়ার কথা।
সোমবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক ও সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়ালি বৈঠকে বিবিএসের ট্যাব কেনার প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। এতে স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো পিছিয়ে যাচ্ছে জনশুমারি।
এদিকে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ও ট্যাব জটিলতায় প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু একাধিকবার পিছিয়েছে। প্রথমে ২০২১ সালের ২ থেকে ৮ জানুয়ারি দেশব্যাপী জনশুমারি হওয়ার কথা ছিল। পরে সেটি প্রায় নয় মাস পিছিয়ে ২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর সময় পুনর্র্নিধারণ করা হয়। কিন্তু সে মেয়াদেও জনশুমারি করতে পারেনি বিবিএস। এরপর ২৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জনশুমারি ও গৃহগণনার পরিকল্পনা হয়। সে অনুযায়ী আর মাত্র চার দিন পরই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। অথচ এরমধ্যে আরও একবার বাতিল করা হলো বিবিএসের ট্যাব কেনার প্রস্তাব।
সময়মতো জনশুমারি না হওয়ায় সঠিক পরিকল্পনার জন্য বিবিএসের কাছে রাষ্ট্রের জনসংখ্যার তথ্য চেয়েও পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়-বিভাগ। সম্প্রতি করোনা প্রতিরোধী টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার জন্য বিবিএসের কাছে বয়স্ক মানুষের তথ্য চায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য খাদ্য, কৃষি, প্রাথমিক গণশিক্ষা অধিদপ্তর, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় এবং জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ও জনসংখ্যার তথ্য চেয়ে বিবিএসকে চিঠি দিয়েছে। অথচ জনশুমারি ও গৃহগণনা না হওয়ায় আপডেট তথ্য দিতে পারছে না বিবিএস।
কোনো দেশ বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ গণনাকেই মূলত আদমশুমারি বা জনশুমারি বলে। একে একটি দেশের জনসংখ্যার সরকারি গণনা হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত বৃহত্তম পরিসংখ্যানিক কার্যক্রম হচ্ছে ‘আদমশুমারি ও গৃহগণনা’।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে প্রথম আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমবার হয় আদমশুমারি ও গৃহগণনা। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘পরিসংখ্যান আইন-২০১৩’ অনুযায়ী ‘আদমশুমারি ও গৃহগণনার নাম পরিবর্তন করে ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ করা হয়। ২০১১ সালের সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার।
বাংলাদেশে ১০ বছর পর আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয়। সবশেষ ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। সে হিসাবে ২০২১ সালে দেশে ষষ্ঠ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
জনশুমারির মাধ্যমে একটি দেশের খানার (গৃহ) সংখ্যা, খানায় বসবাসকারী সদস্যদের সংখ্যা, আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা হয়ে থাকে। এসব তথ্য দেশের সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর আগে প্রতিবারই সঠিক সময়ে জনশুমারির বাস্তবায়িত হলেও মহামারি করোনা ও ট্যাব জটিলতায় ২০২১ সালে তা একাধিকবার পেছানো হয়েছে। ফলে দেশের জনসংখ্যার সঠিক ডাটা/তথ্য চেয়েও পাচ্ছে না রাষ্ট্রের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ ও সংস্থাগুলো।
বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, সঠিক সময়ে জনশুমারি না হওয়ায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষত করোনাকালীন গণটিকাদান ও দেশে মোট জনসংখ্যার হিসাবে খাদ্য চাহিদার পরিমাণ মেলাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।
এছাড়া জনশুমারিতে প্রথমবারের মতো মাল্টিমোড (মোবাইল অ্যাপ, ওয়েব অ্যাপ, পিক অ্যান্ড ড্রপ, পেপার বেজড, কল সেন্টার ইত্যাদি) পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর মাধ্যমে দেশে সীমিত আকারে ই-সেন্সাস পরিচালনা করা হবে। এ শুমারিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিক এবং বিদেশে অবস্থান ও ভ্রমণরত বাংলাদেশি নাগরিকদেরও গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু করোনা-বাধাসহ নানা জটিলতায় বিবিএসের সেই পরিকল্পনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১ প্রকল্পের আওতায় শুরু হতে যাওয়া মহাযজ্ঞে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
দফায় দফায় জনশুমারি পেছানো প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এটা কোভিডের কারণে পিছিয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেছি। আশা করছি, দ্রুত সুরাহা হবে।’