ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

বগুড়ায় ৪ জন নিহতের ঘটনায় থমথমে অবস্থা কালাইহাটা গ্রামে, চলছে শোকের মাতম

বগুড়া প্রতিনিধি : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ৬ জানুয়ারী ২০২২ ০৬:৪৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

বগুড়ায় ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নারীসহ ৪ জন নিহতের ঘটনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে গাবতলী উপজেলার কালাইহাটা গ্রামে, চলছে শোকের মাতম। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কালাইহাটা বাজারের দোকানপাট বন্ধ রেখে গ্রামের লোকজন বাজারে অবস্থান করছেন। সকাল থেকে গ্রামে প্রবেশ করেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য। দুপুরে নিহত চারজনের মরদেহ ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক বলছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জীবন ও নির্বাচনী সামগ্রী রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।

বৃহস্পতিবার সরেজমিন কালাইহাটা গ্রাম ঘুরে দেখা যায় স্থানীয় জনগণ চরম উত্তেজিত। তারা সংবাদ কর্মীদের দেখলেই ‘ম্যাজিস্ট্রেটের ফাঁসি চাই’ বলে শ্লোগান দিচ্ছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বুধবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। কালাইহাটা বাজার ছাড়াও শতশত মানুষ ভীড় করছে নিহতদের বাড়িতে এবং কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে। ভোট কেন্দ্রের মাঠ জুড়ে পড়ে আছে অংসখ্য ইটপাটকেল আর ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো। প্রিজাইডিং অফিসারের ও ভোট গণনার কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ভোটের পরের দিন শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে এলেও ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ আসেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউছুফ আলী বলেন- ভোটের দিন সন্ধ্যায় গুলিতে ৪ জন মারা যাওয়ার পর আতংকে ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসেনি।

বুধবার ভোট গ্রহন শেষে এমন ঘটনার কারণ জানতে চাইলে কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান বলেন- ভোট কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেণ শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আহমেদ। তিনি বিকেল ৫টার দিকে বিজিবিসহ ভোট কেন্দ্রে ঢোকেন। এসময় ভোট কেন্দ্রের বাইরে সবগুলো প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা অবস্থান করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট গাড়িতে বসেই লোকজন সরিয়ে দিতে বিজিবিকে নির্দেশ দেন। লোকজন ফলাফল না নিয়ে যাবে না এমন কথা বললে বিজিবি সদস্যরা প্রথমে নারী সমর্থকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে উপস্থিত লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এর এক পর্যায়ে বিজিবি সদস্যরা গুািল চালায়।

একই গ্রামের বাসিন্দা ফয়জাল প্রামানিক বলেন- ভোট কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করে ব্যালট পেপার উপজেলা সদরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমন খবরে লোকজন উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। এসময় বিজিবি সদস্যরা লাঠিচার্জ করলে জনগণ ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যরা প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে আশ্রয় নেন। সেই কক্ষ থেকেই বিজিবি সদস্যরা গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান নারীসহ চারজন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি অধ্যুষিত বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের মালিয়ান ডাঙ্গা এবং কালাইহাটা গ্রামে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি। কালাইহাটা ভোট কেন্দ্রের ফলাফলের ওপর নৌকা মার্কার জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল। সেই কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে নৌকা মার্কার কর্মী সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা ভোট কেন্দ্রে হামলা করে ভাংচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি সদস্যরা গুলি ছোড়ে। পরে রাত ১০ টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ফলাফলে নৌকা মার্কার প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। 

কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ও শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ বলেন, ‘জনগণকে শান্ত করতে সেখানে আমার দেওয়া বক্তব্যের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড আছে।, জনগণ শান্তি বজায় না রেখে সেখানে হামলা ও ভাংচুর চালায়।’ তিনি বলেন- অন্য ৮ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার দাবি করেন তারা। একপর্যায় কয়েকশ' নারী ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে আমার গাড়িসহ বিজিবির ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, ভোট কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষের দরজা জানালা ভাংচুর করে তছনছ করে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা আত্মরক্ষার্থে প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে অবস্থান নেয়। বিক্ষুদ্ধ লোকজন সেই কক্ষে হামলা চালিয়ে দরজা জানালা ভেঙ্গে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি সদস্যরা গুলি বর্ষণে বাধ্য হন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম জানান, সেখানে নিহত কালাই হাটা গ্রামের খোরশেদ হোসেন (৬০), আব্দুর রশিদ (৫৫), আলমগীর হোসেন (৪৫) ও কুলসুম আক্তারের (৫৫) মরদেহ ময়না তদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ভোট কেন্দ্রে হামলা এবং ৪ জন নিহতের ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি। তবে ওই কেন্দ্রের দায়িত্ব থানা প্রিজাইডিং অফিসার বাদি হয়ে মামলা করবেন বলে উল্লেখ করেন ওসি।

যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার জেলা প্রাশাসক জিয়াউল হক বলেন, অন্যান্য কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে কালাইহাটা কেন্দ্রের ভোট গণনা করতে হবে এমন দাবি না মানায় প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট কেন্দ্রে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচন সামগ্রী ও নিজেদের জীবন রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা সেখানে গুলি ছোড়ে।