ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বাবা-মায়ের পরকীয়া-মাদকাসক্তির বলি হচ্ছে শিশুপ্রাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:৫৬:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

 

প্রতিবেশী লাইলি আক্তারের (৩০) সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ট্রাক্টরচালক আমির হোসেন (২৫)। বয়সে পাঁচ বছরের বড় লাইলির সঙ্গে আমিরের সম্পর্ক বছরখানেকের। হঠাৎ একদিন আমিরকে লাইলির সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে আমিরের পাঁচ বছরের শিশুকন্যা ফাহিমা।

 

ফাহিমা বলে, ‘আমি এ কথা মাকে জানিয়ে দেবো।’ এ কথাই কাল হয় ফাহিমার। ঘটনা চাপা দিতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী লাইলির প্ররোচনায় চকলেট কিনে দেওয়ার কথা বলে ফাহিমাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন বাবা আমির হোসেন।

 

অন্য নারীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলায় শিশুটিকে খুন করতে হাত কাঁপেনি জন্মদাতা বাবার। ঘটনাটি কুমিল্লার দেবিদ্বারের। গত ৭ নভেম্বর নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

৯ নভেম্বর রাতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্যালিকার পাঁচ বছরের শিশু সন্তান সানিকে হত্যা করে শিশুটির খালু চাঁন মিয়া। পরে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনসহ মূল আসামি চাঁন মিয়াকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এ ঘটনার দুই সপ্তাহ না পেরোতেই ২৬ নভেম্বর একই ধরনের আরেকটি নৃশংস ঘটনা ঘটে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে। এবার নেশার টাকার জন্য ২২ দিন বয়সী ছেলে সন্তানকে বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন সুভাস মহন্ত (২৮) নামে পাষণ্ড এক বাবা। পরে তাকে আটক করে পুলিশ।

শুধু ফাহিমা, সানি কিংবা ২২ দিনের শিশু নয়, গত ১০ মাসে শিশুর মা, বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে অন্তত ৫০৯ জন শিশু।

এর মধ্যে অন্যতম, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে মাদরাসাছাত্রী মাইশা হত্যাকাণ্ড। ৩০ অক্টোবর পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় মাইশাকে খুন করে তার মা স্বপ্না আক্তার। ৩ জুন ঠাকুরগাঁওয়ে পরকীয়ার জেরে শিশুপুত্রকে খুন করেন তার মা জান্নাতা। একই কারণে রাজধানীতে ৩০ আগস্ট স্ত্রী ও শিশুপুত্র খুন করেন আবদুল ওয়াহিদ। ১ জুলাই স্বামীর হাতে খুন হন বরগুনার সুমাইয়া ও তার মেয়ে সামিরা আক্তার জুঁই।

পরকীয়া, মাদক, নৈতিক অবক্ষয়, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি ও পারিবারিক বিশৃঙ্খল জীবনে শিশুরা বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা পরিবারের শিশুদের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শিশুর জীবন এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিপন্ন হলে তার ভাই-বোনসহ কাছের শিশুদের জীবনযাত্রায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক বেসরকারি সংগঠন বলছে, শিশুদের ওপর নৃশংসতার তথ্য সংগ্রহ এবং তা প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণা অর্থাভাবে ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে সঠিক তথ্য পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে। হয়তো সহিংসতার শিকার শিশুর সংখ্যা আরও বেশি।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। প্রায় এক যুগ ধরে সংগঠনটি শিশুদের ওপর নৃশসংতার তথ্য ও ডাটা সংগ্রহ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটিতে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে তাদের প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, বিপথে চলে যাওয়া শিশুদের মা-বাবাকে সমাজ ভালোভাবে নেয় না। বৈবাহিক জীবনের বাইরে অন্য নারী-পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না সমাজে। এমন বাস্তবতায় অনেকেই নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। যার প্রভাব পড়ে শিশুসন্তানের ওপর। আবার অন্যদের ফাঁসাতে মা-বাবার সন্তানকে খুন করার মতো নৃশংসতাও ঘটছে হরহামেশা।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিম্নআয় ও শিক্ষার আলো পৌঁছেনি এমন মানুষের মধ্যে শিশুনির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা বেশি। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটলে মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটবে। তখন পারিবারিক স্বস্তি আসবে। লোভের বলি হবে না শিশুরা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৫০৯ শিশুকে খুন করা হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২০৫টি। ১৪৫ শিশুকে বাসা থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে ও অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে ১২৭ শিশুকে। খুন হওয়া শিশুদের মধ্যে ১১৫ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে।

মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে শিশুর প্রতি নৃশংসতার মাত্রা বাড়ছে। শিশুদের প্রতি প্রতিহিংসার জন্য আকাশ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির অপব্যবহার অনেকাংশে দায়ী।

 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীরা সব সময় দুর্বলকে টার্গেট করে। শিশুরা দুর্বল হওয়ায় লোভ ও স্বার্থের জন্য তাদের হত্যা করা হয়। আগে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ ও প্রতিশোধ নিতে শিশুদের খুন করা হতো। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ছিল। এটি ঘটতো বেশিরভাগ পরিচিতজন ও স্বজনদের দ্বারা। কয়েক বছর ধরে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী-স্ত্রীর হাতে সন্তান খুনের ঘটনা বাড়ছে। পারিবারিক অস্থিরতা ও অসততা এর অন্যতম কারণ। তবে এসব ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্তও করা হচ্ছে। গ্রেফতার হচ্ছে অপরাধীরা।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, প্রতিদিন সারাদেশে শিশুনির্যাতন ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। আমরা আগে জানতাম শিশুরা অপরিচিত লোকের কাছে নিরাপদ নয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখছি ভিন্ন। এখন নিজ ঘরেই শিশুদের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হচ্ছে।