শেষ মুহূর্তে অফিস গুছিয়ে নিচ্ছেন বিদায়ী নির্বাচন কমিশনাররা। মেয়াদের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এসেছে তাদের। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিতে হবে পাঁচ বছরের কর্মক্ষেত্র থেকে। নতুন নির্বাচন কমিশনে সাবেক গুরুত্বপূর্ণ আমলারা আসতে পারেন। সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তার নামও আলোচনায় আছে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন সবার জন্য চ্যালেঞ্জ। এ জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন, যারা সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। নতুন ইসিতে কারা আসছেন তা নিয়ে এখন গরম রাজনীতির মাঠ। চলছে জল্পনা-কল্পনা। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকায় নতুন কমিশন নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বিদায় নেবেন। ইতোমধ্যে অফিসের কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন কমিশনাররা। একজন নির্বাচন কমিশনার বৃহস্পতিবার অনেক বইপত্র বাসায় নিয়ে গেছেন। অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারও তাদের ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখছেন।
নানা বিতর্কের মধ্যেই বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। চলমান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে খুনোখুনি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক প্রভৃতি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। তবে বিতর্কের মধ্যেও শেষ মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ভালো হওয়া এ কমিশনের একটি ইতিবাচক দিক। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিজেদের মেয়াদকালের সর্বোত্তম অভিহিত করেছেন ইসি মাহবুব তালুকদার। ভোট শেষে তিনি বলেন, ‘নাসিক নির্বাচন আমাদের কার্যকালে সর্বশেষ সিটি নির্বাচন। এটি ছিল আমার অনেক প্রত্যাশার স্থান। কারণ আমি এর আগে বলেছি- যার শেষ ভালো তার সব ভালো।’ এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে বহুল আলোচিত খসড়া আইনটি আজ সংসদে উঠছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ রবিবার সংসদে তুলে পরীক্ষার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করবেন। সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সংসদীয় কমিটির রিপোর্টের জন্য খুব বেশি সময় দেওয়া হবে না। দ্রুত বিলটি পাস করা হবে। এটি পাস হওয়ার পরই নতুন নির্বাচন কমিশন আইনের আলোকে নিয়োগ করা হবে। কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই নতুন কমিশন গঠন করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। সে ক্ষেত্রে আইনটি সংসদে তোলা থেকে পাস করে গেজেট প্রকাশের জন্য হাতে সময় রয়েছে চার সপ্তাহ।
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে- সাংবিধানিক সংস্থা ইসিতে কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। আর তা একটি আইনের অধীনে হবে। কিন্তু সে আইন না হওয়ায় প্রতিবারই ইসি গঠনের সময় শুরু হয় বিতর্ক। তা এড়াতে ২০১২ সালে নিয়োগের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করেন। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিক নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেন। ওই সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে। সে তালিকা থেকে একজন সিইসিসহ অনধিক পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। মো. আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি পদে আসার পর ২০১৭ সালে জিল্লুর রহমানের দেখানো সে পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। এবারও একই পদ্ধতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সংলাপে অংশ নেওয়া ২৫টি দলের প্রায় সবই ইসি গঠন নিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেয়। আলোচনায় রাষ্ট্রপতিও এ বিষয়ে সম্মত হন বলে দলগুলোর নেতারা জানান। বিএনপিসহ সাতটি দল অবশ্য সংলাপে অংশ নেয়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আগে বলা হয়েছিল, এবার আইনটি করা সম্ভব হবে না। সেই সার্চ কমিটিই এবার আইনের মধ্যে রাখা হচ্ছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সোমবার সাংবাদিকদের জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, নতুন নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের সম্ভাব্য তালিকায় সাবেক আমলা, বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। এক সূত্র জানিয়েছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সাবেক সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সাবেক জেলা জজ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয়েছে। তালিকা ধরে তাদের অতীত ইতিহাস যাচাই-বাছাই চলছে। এর মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে এক ডজন নাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কমিশনার পদের জন্য ২০-২৫ জনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনার পদে বিগত দুটি কমিশনের মতোই এবারও একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, একজন সাবেক জেলা জজ, সিভিল প্রশাসনের সাবেক একজন কর্মকর্তা ও একজন নারী সদস্য নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন।
যেভাবে গঠিত হয় বর্তমান কমিশন : নতুন ইসি গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। অধিকাংশ দলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনের সুপারিশ তৈরির জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য ১০ জনের নাম সুপারিশ করার সময়সীমা দেওয়া হয় সার্চ কমিটিকে। ১০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করতে সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে চার দফা বৈঠক করে। প্রথম বৈঠকে কার্যপরিধি ঠিক করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩১টি রাজনৈতিক দলের কাছে সর্বোচ্চ পাঁচটি করে নাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় বৈঠকে ২৬টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে পাওয়া ১২৫টি নাম থেকে ২০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি এবং তৃতীয় বৈঠকে ওই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে যাচাই-বাছাই ও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। সর্বশেষ বৈঠকে ১০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাতে সে তালিকা তুলে দেয় সার্চ কমিটি। ওই দিনই নতুন ইসি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন সিইসি কে এম নূরুল হুদাসহ নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সদস্যরা। কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। সে হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। স্বাধীনতার পর ১২ জন সিইসি ও ২৭ জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন।