একে একে পেরিয়ে গেছে চার বছর। প্রকল্পের বেঁধে দেওয়া মেয়াদও শেষ। অথচ যশোর, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও পাবনার বিদ্যমান মেডিকেল কলেজের জন্য ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণে কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে প্রকল্প থেকে ঋণ বাতিল করেছে ভারত। নতুন করে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে শুরু হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। ফলে বাড়ছে প্রকল্পের সময়-ব্যয়।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা যায়, ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ৫০০ বেডেড হাসপাতাল ও এনসিলারি ভবন ইন পাবনা, যশোর, কক্সবাজার ও আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড জননেতা নুরুল হক আধুনিক হাসপাতাল, নোয়াখালী’ প্রকল্পের আওতায় এ ঘটনা ঘটেছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মে মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিল ৬৬৩ কোটি ৩২ লাখ এবং ভারতীয় ঋণ ছিল ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মাত্র ০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে অবকাঠামোগত অগ্রগতি শূন্য।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য উইং) ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন বলেন, প্রকল্পটি সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ঋণে ভারতের কিছু শর্ত ছিল, সেটা পূরণ হয়নি। প্রকল্পটি এখন সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবনা নিয়ে সামনে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রকল্প থেকে ভারতীয় এলওসি বাদ পড়ছে। প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ৭৮১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ সরকারি খাত থেকে ব্যয় করা হবে। অনুমোদিত প্রাক্কলন ব্যয়ের তুলনায় প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধনের প্রাক্কলিত ব্যয়ের পরিমাণ ৬৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি। নতুন করে প্রকল্পটির মেয়াদ জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুন মেয়াদে সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ জানায়, ভারতীয় ঋণ প্রাপ্তি থেকে অনেক আগেই প্রকল্পটি বাদ দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপ-সচিব (ভারত) মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ওই প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণ প্রাপ্তির তালিকায় আর নেই। আমি ইআরডিতে আসার আগেই এটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় ঋণ কেন বাদ গেছে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি মুহাম্মদ রেজাউল করিম।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের দাবি, হাসপাতালের কাজের মানের সঙ্গে কোনো কম্প্রমাইজ করা হবে না। শিডিউল অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বেশি কাজ করার প্রয়োজন নেই। তবে ঠিকাদার যেন চুক্তির চেয়ে কম কাজ না করতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। হাসপাতালগুলোতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে সাশ্রয় হবে জায়গার। এতে ভবন নির্মাণে ব্যয়ও কমে আসবে এবং হাসপাতালের খালি জায়গায় অধিক সংখ্যক বৃক্ষরোপণ করে সৌন্দর্য বাড়ানো সম্ভব হবে। ভারসাম্য বাড়বে পরিবেশের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মূল প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন গণপূর্ত বিভাগের ২০১৪ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী করা হয়েছিল। বর্তমানে ২০১৮ সালের রেট শিডিউলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সে মোতাবেক ভবনগুলোর সব কিছুর নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ওপর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক যত তলা ভিত্তি, তত তলা বিল্ডিং নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া ভবন বাড়ার সঙ্গে আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খরচ বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে বেড়েছে সংশোধিত প্রকল্পের ব্যয়।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ
রেট শিডিউল পরিবর্তন: প্রকল্পটিতে গণপূর্ত বিভাগের ২০১৪ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। ফলে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।
বিভাগের সংখ্যা বৃদ্ধি
মূল অনুমোদিত প্রকল্পে ২১টি বিভাগের সঙ্গে নতুন করে ১০টি বিভাগ সংযুক্ত করা হয়েছে। বিভাগ বাড়ার সঙ্গে আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ও সংশ্লিষ্ট অন্য খরচও বেড়েছে।
নতুন পদ সৃজন
মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য নতুন নতুন পদ সৃজন করা হয়েছে। এতে বাড়তি অবকাঠামোও নির্মাণ করতে হবে। এসব কারণেও প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়বে।
মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পুনর্র্নিধারণ
বিভাগ বাড়ানোর জন্য মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পুনর্র্নিধারণ করা হয়েছে। ফলে এ খাতেও বাড়ছে ব্যয়।
ভূমির মূল্য পরিশোধ: কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জমির দাম পরিশোধ হয়নি। প্রশাসকের প্রাক্কলন অনুযায়ী জমির মূল্য পরিশোধের জন্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকার প্রয়োজন। এজন্যও মূল প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়বে।
ন্যাশনাল গ্রিডের টাওয়ার স্থানান্তর
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত স্থানে দুটি ন্যাশনাল গ্রিডের টাওয়ার ও লাইন আছে। এই টাওয়ার স্থানান্তর না হলে মূল হাসপাতাল ভবন নির্মাণ সম্ভব নয়। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) মাধ্যমে টাওয়ার ও লাইন স্থানান্তরের জন্য প্রায় ১০ কোটি টাকার প্রাক্কলন দেওয়া হয়েছে। এ অর্থের জন্য সংশোধিত প্রকল্পে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আবাসিক চিকিৎসক ও সার্জনের জন্য আবাসন
আবাসিক চিকিৎসক, আবাসিক সার্জনের মতো ফুলটাইম চিকিৎসকদের নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে হাসপাতাল ক্যাম্পাসে অবস্থান করা জরুরি। মূল প্রকল্পে আবাসিক চিকিৎসক ও আবাসিক সার্জনের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা ছিল না। নতুন সংশোধিত প্রকল্পে এ উদ্দেশ্যে একটি অতিরিক্ত ভবনের জন্য অর্থের প্রস্তাব রয়েছে।
বেজমেন্টের ফোর্স ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা
আরডিপিপিতে (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) বেজমেন্টের ফোর্স ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ছিল না।
আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার প্রস্তাব: বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আগুনে পোড়ানোর প্রক্রিয়া বর্তমানে অস্বাস্থ্যকর ও যুগপোযোগী নয়। আরডিপিপিতে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সাব-স্টেশন ও জেনারেটর স্থাপন: ওটি, সিসিইউ, আইসিইউ, এইচডিইউ, ডায়ালাইসিস ইউনিটের জন্য সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অপরিহার্য। এজন্য আরডিপিপিতে সাব-স্টেশন ও জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ডিপিপিতে ছিল না।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
চারটি জেলায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। আধুনিক চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নত করা। এক হাজারের বেশি ডাক্তার ও অন্যান্য পেশাজীবীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশে অনেক উন্নতি করলেও এ খাতকে বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করতে সেবার পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালগুলো যথাক্রমে প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা দেয়। সরকারিভাবে টারশিয়ারি স্বাস্থ্যসেবামূলক কার্যক্রম সাধারণত জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে টারশিয়ারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এ দিকটি বিবেচনায় এনে টারশিয়ারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় চারটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়িত সেক্টর কর্মসূচির আওতায় এসব মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ভবন তৈরি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীসময়ে মেডিকেল কলেজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা না করায় একদিকে এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণ উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম
প্রতিটি মেডিকেল কলেজে ১০ তলা ভিতের ওপর ১০ তলা হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হবে। আয়তন হবে ২৫ লাখ ৭ হাজার ৭৩২ ফুট। ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হবে, যার প্রতিটি হবে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৬ বর্গফুটের। ২ লাখ ৩৯ হাজার বর্গফুটের ইস্টার্ন ডরমিটরি নির্মাণ করা হবে।
চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৩ লাখ ১৪ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের জন্য কেনা হবে ৩১ হাজার ৬১০টি আধুনিক মেডিকেল যন্ত্রপাতি। এছাড়া ১১টি যানবাহন ও ৩২ হাজার ২৫৩টি আসবাবপত্র কেনা হবে।