বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ভারতের সঙ্গে শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। গত এক দশকে দ্রুত গতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অন্যতম প্রধান এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে ২০২৩-২৪ সালে জাপান, জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো বিশ্বের অনেক শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বেশি ছিল।
তবে চলমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করেছে এবং ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি হলো গত এক দশকে বা তারও বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত তার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে বার্ষিক ৬ দশমিক শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ১২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ তিনগুণ বেড়েছে। মাথাপিছু জিডিপি ২০০৯ সালে ৮৪১ মার্কিন ডলার থেকে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ২০১৫ সালে নিম্ন-আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কমবয়সী দেশটি। বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী জনসংখ্যার হার ২০১০ সালে ছিল প্রায় ১২ শতাংশ যা ২০২২ সালে কমে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গত দশকে মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) উল্লেখযোগ্য উন্নতির সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) অনুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের এইচডিআই মান ছিল ০.৬৭ যা ২০১০ সালে ছিল ০.৫৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের পণ্যদ্রব্য রপ্তানি ২০০৯ সালে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে আমদানি ২০০৯ সালে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নতি হয়েছে।
তবে ২০২৩ সালের দিকে কিছুটা হ্রাস দেখা গেছে। এ সময় আমদানি ছিল ৬৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা ভারতের সঙ্গে এর বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করেছে। গত দেড় দশকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের উত্থানও আন্তঃশিল্প বিশেষ করে টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতের মাধ্যমে গতিশীল হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের মোট পণ্য বাণিজ্যের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে ভারতের বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যের মূল্য ২০০৯ সালের মূল্যের আড়াই গুণ ছিল। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের আকার ছিল ৫ দশমিক ৫ গুণ।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক পণ্য বাণিজ্যের আকার ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানিও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মোট রপ্তানির তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ ভারতের পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ ২০০৯ সালে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ভারতের পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো কয়েকটি বড় অর্থনীতির
দেশের তুলনায় বেশি ছিল।
বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ২০২১ সালে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে যা ২০২২ সালে ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৩ সালে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। ভারতীয় রপ্তানি হ্রাস মূলত বাংলাদেশের আমদানির চাহিদার সামগ্রিক হ্রাসের কারণে হয়েছে। মূলত একাধিক চ্যালেঞ্জের কারণেই এমনটা হয়েছে, যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হওয়া। চলমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিবেশের আরও অবনতি ঘটাতে পারে এবং ভারত থেকে আমদানির চাহিদার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ভারতের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এগুলো যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় এবং এতে তুলা, জ্বালানি পণ্য, শাকসবজি, কফি এবং চা, অটোমোবাইল পণ্য, যন্ত্রপাতি এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ধাতব পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানি কয়েকটি খাতে। উদাহরণস্বরূপ ২০২৩ সালে ভারতীয় আমদানির ৫৯ শতাংশেরও বেশি টেক্সটাইল এবং পোশাক পণ্য নিয়ে গঠিত। আমদানির অন্যান্য আইটেমের মধ্যে রয়েছে মাছ, চামড়াজাত পণ্য এবং জুতা।
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অনুপাত শ্রমনির্ভর পণ্য নিয়ে গঠিত। সে কারণে তাদের চাহিদার ওপর বিরূপ প্রভাব শুধুমাত্র রপ্তানি আয়ের ক্ষতিই নয় বরং ভারতীয় শ্রমিকদের চাকরির বাজারেও প্রভাব ফেলবে।
ভারতে যে শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তা হলো টেক্সটাইল এবং পোশাক যা বাংলাদেশে ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ২৪ শতাংশ। তবে বস্ত্র ও পোশাক খাতে বিশেষ করে পোশাক খাতে বাংলাদেশ ভারতের প্রতিযোগী হওয়ায় সামগ্রিক প্রভাব মিশ্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটলে তুলা আমদানির চাহিদা হ্রাস পাবে, যা বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানির একটি প্রধান উপাদান। যেহেতু বাংলাদেশ ভারতীয় তুলার সবচেয়ে বড় বাজার, ভারতের তুলার বৈশ্বিক রপ্তানির প্রায় ৩৫ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। তাই এর চাহিদায় ব্যাঘাত ঘটলে তুলার উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত কৃষকসহ ভারতীয় স্টেকহোল্ডারদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশে আমদানির চাহিদা কমে যাওয়ায় ভারতে তুলার দাম কমে যেতে পারে যা ভারতীয় পোশাক খাতের ব্যয় প্রতিযোগিতার উন্নতিতে সাহায্য করবে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বড় প্রতিযোগী, সেদেশে সরবরাহ ব্যহত হলে বিশ্ববাজারে ভারতীয় পোশাক পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে।
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের পক্ষে বাংলাদেশের সরবরাহকে প্রধান উপায়ে প্রতিস্থাপন করা কঠিন হবে কারণ তাদের দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতা পর্যাপ্ত নয়।
ভারত বাংলাদেশে বেশ কিছু কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। চলমান বিরোধ এই চাহিদাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং কৃষিপণ্য সরবরাহের সঙ্গে জড়িত কৃষকসহ সমস্ত স্টেকহোল্ডাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ভারতীয় চা ও কফির ক্ষেত্রেও একটি প্রধান বাজার। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তা হলো ভারতের জ্বালানি খাত কারণ বিশ্ববাজারে ভারতের জ্বালানি রপ্তানির ২ দশমিক ৬ শতাংশই বাংলাদেশে।
বেশ কয়েকটি ভারতীয় পণ্যের জন্য বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু চলমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে এবং ফলস্বরূপ ভারত থেকে সেই পণ্যগুলোর চাহিদা হ্রাস হতে পারে। যদিও এই সংকটটি বৈশ্বিক পোশাকের বাজারে ভারতের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে, তবে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের পর্যাপ্ত সরবরাহের সক্ষমতা না থাকার কারণে তারা পিছিয়ে পড়তে পারে।