রাজনৈতিক কোন্দলে গত কয়েক মাসে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, খুলনা, লক্ষ্মীপুরে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, এসব খুনের ঘটনায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আশঙ্কা করা হচ্ছে নির্বাচনে এসবের ব্যবহার বেড়ে যেতে পারে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, কারা অবৈধ অস্ত্র দেশে আনছেন, কারা কিনছেন, কারা ব্যবহার করছেন- সার্বিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হালনাগাদ বৈধ অস্ত্রের তথ্যভান্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফএএমএস) সূত্র থেকে জানা যায়, দেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪৪ হাজার ১০৪টি। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্র বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত। পুলিশ বলছে, বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করার জন্য এই তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে। সূত্র জানায়, গত বছর আগস্ট থেকে অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে দেশের বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারের কাছে এসবির ক্লিয়ারেন্স নিতে আবেদন করেছেন একাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
জানতে চাইলে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। এসব অস্ত্রের একটি অংশ আসে পাশের দেশ থেকে। এ ছাড়া বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়েও দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আসা ঠেকাতে নিরাপত্তা জোরদার ও দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। তা না হলে নির্বাচন ছাড়াও নানা সহিংসতায় এসব অস্ত্র ব্যবহার করবে দুর্বৃত্তরা। র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বছরজুড়েই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে থাকে র?্যাব। এটা চলমান থাকবে। যেসব স্থানে অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা হতে পারে সেসব স্থান, যারা জড়িত সেসব ব্যক্তি কিংবা তালিকাভুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ী যারা পলাতক থাকেন, এদের বিষয়ে আমরা সব সময় গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে থাকি। আর যেহেতু সামনে নির্বাচন, একে কেন্দ্র করে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। তবে আমাদের অভিযানও বেড়ে যাবে এবং আমরা জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হব।’ গত তিন বছরে র?্যাব ২ হাজার ৪০৭টি অবৈধ অস্ত্র জব্দ করেছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ৮৪৬টি অস্ত্র জব্দ করা হয়। পরের বছর জব্দ করা হয় ১ হাজার ৩৯৪টি অস্ত্র। আর চলতি বছরে মে মাস পর্যন্ত ১৬৭টি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। এসব অস্ত্র জব্দের সময় মামলায় র?্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ৫৯৫ জন।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মনজুর রহমান বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে, চলবে। নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনা রয়েছে এবং অবশ্যই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান জোরদার করা হবে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) সীমান্তে অবৈধ অস্ত্র জব্দ করে। বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, চলতি বছর প্রথম চার মাসে তারা ৪৫টি অবৈধ অস্ত্র জব্দ করেছে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আনছার উদ্দীনকে (৬০) গত ২৪ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয়। কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ৩০ এপ্রিল যুবলীগ নেতা জামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রাজনৈতিক কোন্দলের জের ধরে ২৫ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নারায়ণগঞ্জে ফাঁকা গুলি করার একটি ভিডিওর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া যুবক হাফিজুর রহমান সোহান (২৭) ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন। ফতুল্লার পাগলা বউবাজার এলাকায় তাকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাত করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশে ৪৭৫টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭০ জন মারা গেছেন। আর চলতি বছর মে মাস পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় খুন হয়েছেন ১০ জন। এ ছাড়া সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৫০টি এবং এতে আহতের সংখ্যা ২ হাজার ১৬৭ জন। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ১৫-২০ বছর আগে নির্বাচনের সময় অস্ত্রের ঝনঝনানি বেশি দেখা যেত। এখন আর সেভাবে দেখা যায় না। তবে যাদের বৈধ অস্ত্র আছে সেগুলো জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা রাখা এবং থানা পুলিশ দিয়ে হালনাগাদ তথ্য রাখতে হবে। এ ছাড়া অবৈধ অস্ত্র ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি ও তল্লাশি বাড়াতে হবে। আর অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোয় বিশেষ নজর দিতে হবে। এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র-সংশ্লিষ্ট মামলায় ১ হাজার ৮৩৫টি ইমেজ (আলামত) তাদের ফরেনসিক বিভাগের আবিস সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২০২১ সালে ২৩৩টি ডাটা ইমেজ সংরক্ষণ করা হয়। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ১৯৩টি গুলির ঘটনার আলামত পরীক্ষা করেছে। তাদের সংরক্ষণাগারে আগের বিক্রীত অস্ত্রের আলামতের পাশাপাশি নতুন করে বিক্রীত অস্ত্রের আলামতও সংগ্রহ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা ধরে রাখতে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়। আমরা অতীতে এমন ঘটনা বহু দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এসব অস্ত্র জব্দ করার চেষ্টা করেন। নির্বাচনে অনেক প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা কার বেশি শক্তি তা জানান দিতে অস্ত্রের ব্যবহার করে থাকেন। তখন প্রতিযোগিতা প্রতিহিংসায় রূপ নেয়। তবে অবৈধ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভয়ভীতিহীন নির্বাচন করা সম্ভব নয়।