বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২৫ দিন পর দেশের মাটিতে পা রাখেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তির পর লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বেলা ১টা ৪১ মিনিটে তাঁকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমান ঢাকায় অবতরণ করে। বিমানটি বাংলার মাটি ছোঁয়ার আগে ঢাকার আকাশে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরতে থাকে। ওপর থেকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দেখার ইচ্ছা পূরণে বিমানটি আকাশে চক্কর দেয়।
এ বিষয়ে ওই সময়কার পত্রিকার খবরের উদ্বৃতি দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান তার একটি কলামে লিখেছেন, ‘‘ঢাকায় অবতরণের আগে কমেট বিমানটি বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রায় ৪৫ মিনিট বিমানবন্দরের ওপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। ওপর থেকে তাঁর ‘সোনার বাংলা’কে অবলোকন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।’’
১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা প্রত্যাবর্তন করলে বিমানবন্দরে তাঁকে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানানো হয়। এর আগে দিল্লিতে তাঁকে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করামাত্র সেখানে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। পরে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) যান জাতির পিতা। দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে রওনা দিয়ে জনতার ভিড় ঠেলে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছেন বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছিল ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। যাত্রাকালে খোলা ট্রাকের ওপরে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে একনজর দেখার জন্য রাস্তার দুই ধারে প্রতীক্ষায় থাকা লাখো মানুষ ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানায়। সুদৃশ্য তোরণ, বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের জনসমুদ্র পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছান।
বঙ্গবন্ধুর লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার ঘটনা বর্ণনা করে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু লন্ডনে একদিন অবস্থানের পর ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর বিমানে করে ঢাকা ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি দেন। সেই যাত্রাবিরতি শুধু যাত্রাবিরতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সীমাহীন অবদানের স্বীকৃতি এবং সে দেশের সরকার ও জনগণের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বিরতি। দিল্লি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। অন্য দেশের একজন নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হবেন, এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আর ইতিহাসের সেই বিরল দৃষ্টান্তটি সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল যাকে কেন্দ্র করে, তিনি আর কেউ নন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা এবং অন্যান্য অপরাধে ১১ আগস্ট সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই অপরাধে বঙ্গবন্ধুর প্রাণদণ্ডও হতে পারে বলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদে ঘোষণা দেন। ওই বিচার প্রসঙ্গে আহমেদ সালিমের লেখা ‘পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দি জীবন’ শীর্ষক বইয়ের উদ্বৃতি দিয়ে তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন,
‘‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের প্রধান কারাগার লায়ালপুর জেলে রাখা হয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সামরিক আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। বিচারের রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সময় ইয়াহিয়া খান বলেছিল, বিনা শাস্তিতে সে পার পাবে না। ফলে বিচারটা ছিল প্রহসনের। গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আদালতে চুপচাপ বসে থাকতেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে তাঁর পক্ষে নিয়োগ করা আইনজীবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মুজিব নিজের পক্ষে কোনও অবস্থান নিতে চান কিনা।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনও অধিকার এদের নেই। আইনের দিক দিয়ে কোনও বৈধতা এই আদালতের নেই।’’
আহমেদ সালিমের বই থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রহসনমূলক বিচরের রায়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। ফাঁসির রায় কার্যকর করতে তাঁর কারাকক্ষের পাশে কবরও খোঁড়া হয়। ফাঁসি দেওয়ার নির্ধারিত দিন জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘যদি মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হয় তবে বাঙালির ক্রোধের লক্ষ্য হবে পূর্বাঞ্চলে মোতায়েনকৃত পাকবাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার থেকে সর্বনিম্ন সৈনিক পর্যন্ত সবাই।’ ভুট্টোর উপদেশে ইয়াহিয়া খান মুজিবের ফাঁসি স্থগিত রাখেন। কয়েক দিনের জন্য কবর ভরাট করা হয়। ১৫ দিন পর একইভাবে গর্ত খোঁড়ার হুকুম আসে। এবারও শেখ মুজিবের ফাঁসি দেওয়া হলো না। এমনই প্রক্রিয়া তিনবার ঘটেছিল এবং তিনবারই তাঁর ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে, ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে আবেদন করেছিল, ‘আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হলো শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হোক।’
ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসীর মামুন তার ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের জেলখানা থেকে মুক্তি দেওয়ার সময়কার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ও বঙ্গবন্ধুর একটি কথোপকথনের তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ৮ জানুয়ারি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জেলখানায় আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন, ‘মুজিব এখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।’ মুজিব উত্তরে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসেবে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের নয়। হালকা হাসিঠাট্টার পর ভুট্টো জানালেন, পূর্ব পাকিস্তান এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। মুজিব এখন ঢাকা ফিরে যেতে পারেন। দিল্লি হয়ে তিনি যাবেন। সেখানে তাঁকে গার্ড অব অনার নিতে হবে। ভুট্টো আদেশ দিলেন মুজিবকে নতুন কয়েকটি প্রিন্সকোট দিতে।