ঢাকা, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তা চাষে সম্ভাবনা, বিক্রি নিয়েই দুর্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ২৯ নভেম্বর ২০২১ ০৪:১১:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাছ চাষি তাজ আহমেদ। পুকুরে রুই-কাতলসহ নানা প্রজাতির দেশি মাছ চাষ করছিলেন তিনি। একদিন ইউটিউবে মুক্তা চাষের ভিডিও দেখেন। এতে মুক্তা চাষে আগ্রহ জন্মে তার। আগ্রহ থেকেই এ সংক্রান্ত প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর ২০১৯ সাল থেকে তাজ শুরু করেন মুক্তা চাষও। এরই মধ্যে ৪০০টি উন্নতমানের মুক্তা উৎপাদন করেছেন তিনি। এই মুক্তা তার মুখে হাসি আনলেও দুর্ভাবনা বিক্রি নিয়ে। দেশে মুক্তা বিক্রির কোনো কেন্দ্র না থাকায় সম্ভাবনার এই পণ্য নিয়ে তাজ পড়েছেন জটিলতায়। এ অবস্থায় তিনি এখন বাধ্য হয়ে অনলাইনে মুক্তা বিক্রি করছেন।

মুক্তা চাষি তাজ আহমেদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল মোবাইল ফোনে। তিনি বলেন, দুই বছর আগে থেকে মুক্তা চাষ শুরু করি। এরই মধ্যে ৪০০ মুক্তা বিক্রি করেছি। অনলাইনে প্রতিটি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এছাড়া আড়ত থেকে ২৭০ টাকায় কিনে নিয়ে যান ক্রেতারা। অনলাইন ও আড়ত ছাড়া মুক্তা বিক্রির কোনো জায়গা নেই।

১০০ থেকে শুরু করে এখন ৯০০টি পর্যন্ত মুক্তা চাষ করি। বর্তমানে অনলাইনেই সব বিক্রি করি। কিন্তু দেশে মুক্তা বিক্রির কোনো শোরুম বা প্রতিষ্ঠান নেই। অনলাইনে আর কত বিক্রি করবো? যারা অর্নামেন্ট নিয়ে কাজ করেন তারা যদি আমাদের সহযোগিতা করেন তাহলে অনেক ভালো হবে। আমরা উপকৃত হবো। মুক্তা বিক্রির সঠিক বিপণনকেন্দ্র দরকার। যদি না হয় তবে মুক্তা চাষের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে 

দেশে ধান, চাল, মাছ—সব বিক্রির জায়গা থাকলেও মুক্তা বিক্রির কোনো জায়গা নেই উল্লেখ করে তাজ আহমেদ বলেন, মুক্তা বিক্রির নিয়ে শঙ্কার কারণে আমরা উৎপাদন কম করছি। বিপণন কেন্দ্র বা তেমন প্ল্যাটফর্ম থাকলে আরও বেশি উৎপাদন করতে পারবো। অনেকে এতে আগ্রহী হবে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার শাপলেজা ইউনিয়নের শাওন মুন্সিও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিশাল মাছের ঘেরে এক হাজার মুক্তা উৎপাদন করেছেন। কিন্তু কোথায় মুক্তা বিক্রি করবেন, তার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

শাওন মুন্সি বলছিলেন, প্রথমে এক হাজার মুক্তা উৎপাদন করেছি। কিন্তু কোথায় বিক্রি করবো ভেবে পাচ্ছি না। এই মুক্তা যদি সঠিক দামে বিক্রি না করতে পারি তবে উৎসাহ হারানো ছাড়া কোনো পথ নেই।

 শুধু অলংকার নয়, মুক্তার রয়েছে আরও নানাবিধ ব্যবহার। ওষুধ এবং দামি ক্রিম তৈরিতে মুক্তা ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে মুক্তার উৎপাদন হচ্ছে, তবে সেভাবে এখনো বিপণনকেন্দ্র তৈরি হয়নি। এজন্য আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্টদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে চাষিদের কাছ থেকে মুক্তা কিনতে 

ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার। বাড়ি তার বরিশাল সদরে। সাদিয়া ২০১৮ সাল থেকে মুক্তা চাষ শুরু করেন। প্রথমে ১০০টি উৎপাদন করেন। এখন তিনি বছরে ৯০০টির মতো মুক্তা উৎপাদন করতে পারেন। পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন সাদিয়া। ঢাকা থেকে প্রতি দুই মাস পর বাড়িতে গিয়ে মুক্তা চাষ দেখে আসেন। বাড়িতে এসব মুক্তা চাষ দেখভাল করেন তার নানা রতন উদ্দিন। কিন্তু আলংকারিক পণ্যটি বিক্রির জায়গা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন সাদিয়াও।

 

তিনি বলেন, ১০০ থেকে শুরু করে এখন ৯০০টি পর্যন্ত মুক্তা চাষ করি। বর্তমানে অনলাইনেই সব বিক্রি করি। কিন্তু দেশে মুক্তা বিক্রির কোনো শোরুম বা প্রতিষ্ঠান নেই। অনলাইনে আর কত বিক্রি করবো? যারা অর্নামেন্ট নিয়ে কাজ করেন তারা যদি আমাদের সহযোগিতা করেন তাহলে অনেক ভালো হবে। আমরা উপকৃত হবো। মুক্তা বিক্রির সঠিক বিপণনকেন্দ্র দরকার। যদি না হয় তবে মুক্তা চাষের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে।

দেশে মুক্তা চাষ প্রচলনের পথিকৃত বলে পরিচিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। তারা বলছে, এই পণ্যটির উৎপাদন বাড়াতে জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০১৯ মেয়াদে ‘মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গবেষণার মাধ্যমে টেকসই মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের প্রজনন ও কৌলিতাত্ত্বিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষক, গ্রামীণ নারী এবং উদ্যোক্তা পর্যায়ে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ।

ওই প্রকল্পের আওতায় মোট দুই হাজার ১২০ জন এবং রাজস্ব বাজেটের আওতায় আরও ১০০ জনকে মুক্তা চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা, মাছচাষি এবং বেকার যুবক মুক্তা চাষ শুরু করেছেন।

ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনা, ঝিনাইদহ, সিলেট, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লাসহ দেশের ৪০ জেলার ৮২ উপজেলার মোট ১৫০ জন প্রান্তিক খামারি মুক্তা চাষে সরাসরি সম্পৃক্ত। বর্তমানে দেশে ৩২ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে প্রায় পাঁচ লাখ ২০ হাজার অপারেশনকৃত ঝিনুকে মুক্তা চাষ করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার ইমেজ (ইউনিট) মুক্তা উৎপাদন করা হয়েছে। আহরিত মুক্তা অনেকেই অলংকার তৈরির কাঁচামাল হিসেবে সরাসরি বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে অলংকার তৈরি করে দেশ-বিদেশে অনলাইন এবং সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন। এ প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার মুক্তা এবং অলংকার বিক্রি হয়েছে।

প্রতি ইমেজ মুক্তা উৎপাদনে ১৫ থেকে ৩০ টাকা খরচ করে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করেন চাষিরা। এতে প্রতি ইমেজ মুক্তায় ২২০ থেকে ২৭০ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।

২০ জন মুক্তা চাষির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, মাছ চাষের পাশাপাশি মুক্তা চাষ করে তারা এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ টাকা (উৎপাদন খরচ বাদে) লাভ করেছেন। মুক্তা বিক্রির পাশাপাশি আগ্রহী চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

মুক্তা জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভেতর জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরনের রত্ন। বাহিরের কোনো বস্তু ঝিনুকের দেহের ভেতর ঢুকে নরম অংশে আটকে গেলে আঘাতের সৃষ্টি হয়। ঝিনুক এ আঘাতের অনুভূতি থেকে উপশম পেতে বাইরে থেকে প্রবেশকৃত বস্তুটির চারপাশে এক ধরনের লালা নিঃসরণ করতে থাকে। ক্রমাগত নিসৃত এই লালা বস্তুটির চারদিকে ক্রমান্বয়ে জমাট বেঁধে মুক্তায় পরিণত হয়। মুক্তা মূলত ঝিনুকের কষ্টের ফল।

কৃত্রিম উপায়ে এভাবে মুক্তা উৎপাদন করতে বড় অংকের বিনিয়োগ করছেন চাষিরা। কিন্তু বিপণনকেন্দ্র না থাকায় যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে সেভাবে লাভ মিলছে না তাদের।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, মুক্তা অতি প্রাচীন, মূল্যবান রত্ন। এটি একমাত্র রত্ন, যা জীবন্ত প্রাণী থেকে পাওয়া যায়। এটি আভিজাত্যের প্রতীক। শুধু অলংকার নয়, মুক্তার রয়েছে আরও নানাবিধ ব্যবহার। ওষুধ এবং দামি ক্রিম তৈরিতে মুক্তা ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে মুক্তার উৎপাদন হচ্ছে, তবে সেভাবে এখনো বিপণনকেন্দ্র তৈরি হয়নি। এজন্য আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্টদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে চাষিদের কাছ থেকে মুক্তা কিনতে।