ঢাকা, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

মোরা এক বৃন্তে দুই কুসুম হিন্দু-মুসলমান

Author Dainik Bayanno | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ১২:০৬:০০ অপরাহ্ন | সাহিত্য

দেয়ালের পশ্চিম পাশে অখন্ডমন্ডলেশ্বর শ্রীশ্রীমৎস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সনাতন ধর্মের অযাচক আশ্রম। আর তারই সীমানা ঘেঁষে দেয়ালের পূর্ব পাশে হাকিম মাওলানা মোবারক আলী হেজাজী ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রহিমপুর হেজাজীয়া এতিমখানা ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা।

আশ্রমে সকালে চলে সমবেত প্রার্থনা আর হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ছাত্ররা দরদ দিয়ে ধারাজ কন্ঠে তেলাওয়াত করেন আল-কোরআন। সন্ধ্যায় মন্দিরে বাজে ঘন্টা অপরদিকে দেয়ালের ওপাশে মাদ্রাসা মসজিদে হয় সুমধুর সুরে আজান। মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রান। এ যেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের লিখা হিন্দু-মুসলমান কবিতাটির দুটি লাই চরম সার্থকতা পেয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে প্রায় ৩৬ বছর ধরে পথ চলছে এই দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ভাতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এ প্রতিষ্ঠান দুটি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নে অবস্থিত।

মুরাদনগর বেসরকরী এতিম কল্যাণ পরিষদের সেক্রেটারি ও হেজাজীয়া এতিমখানা এবং হাফেজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক কাজী লোকমান বলেন, ‘হাকিম মাওলানা মোবারক আলী হেজাজী ১৯৮৬ সালে এতিমখানা মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৫ সাল থেকে একশ আটচল্লিশ জন ছাত্র সমাজ সেবা কর্তৃক অনুদান পাচ্ছে। দশ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ছাত্র সংখ্যা তিনশ পঞ্চাশ। ১৬জন শিক্ষক ১জন অফিস সহকরি ও ৪জন বাবুর্চি কর্মরত আছে এ প্রতিষ্ঠানে। বড় এই প্রতিষ্ঠানটির সিমানা ঘেঁষে রয়েছে সনাতন ধর্মের অযাচক আশ্রম। তিন যুগের বেশি সময় আমরা পাশা-পাশি আছি। একদিনের জন্যও একে অপরের ধর্মীয় কাজে কোন কারণে ব্যাঘত ঘটেনি। অধ্যক্ষ মানবেন্দ্র সাহেবের আশ্রমে মাঘ মাসের পাঁচ, ছয় ও সাত এই তিন দিন ব্যাপি বাৎসরিক ‘আগমনী উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ভারত তথা বিভিন্ন দেশের ভক্ত-বৃন্দি আসেন। ওই অনুষ্ঠানের পূর্বে তিনি আমার সাথে বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে নেন এবং আমাকে চিঠি দিয়ে দাওয়াত করেন। আমিও যখন মাহফিল করি তখন তাকে দাওয়াত দেই। কেননা ইসলাম শান্তির ধর্ম। আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা আমাদের কাছে আমানত। আমানত খেয়ানত করলে হাসরের মাঠে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বন্ধন অটুট রেখেই আমরা প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ ডা: মানবেন্দ্র নাথ সরকার বলেন,‘ অখন্ডমন্ডলেশ্বর শ্রীশ্রীমৎ স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব ১৯৩১ সালে অযাচক আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমি ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ১৯৯৪ সালে এই আশ্রমে যোগদান করি। বর্তমানে এখানে ৫জন সেবক ও ৩০ জন ছাত্র রয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই আশ্রমের শাখা আছে। আমরা সবাই নিরামিষভোজী। আশ্রমের পুকুরের মাছ ও সব্জি চাষ থেকে আসা আয় দিয়ে খরচ চলে যায় আমাদের। সকালে সমবেত প্রার্থনা ও বাকি সময় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবায় দিন চলে যায়। প্রতিদিনই কয়েকশ লোকের সমাগম হয় আশ্রমে। তবে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো আমাদের সিমানার ওয়ালের ওপাশে রয়েছে এতিমখানা মাদ্রসা ও মসজিদ। এতে আমাদের কোন প্রতিরন্ধকতা নেই। কারণ কিভাবে পারস্পরিক সহনশীলতা নিয়ে ধর্ম-কর্ম করা যায় তার উদাহরণ হচ্ছে আমাদের দুই প্রতিষ্ঠান। আমরা পারস্পরিক সহনশীলতার চর্চা করি। একবার তাদের মাহফিলের সময় আমাদের অনুষ্ঠানের ডেট পরে গেল। তাই তাঁরা তাদের মাহফিল পিছিয়ে দিয়েছেন। এই যে মহানুভবতা এটাইতো ধর্ম। আমাদের তিন দিন ব্যাপী বাৎসরিক ‘আগমী উৎস’বে বিভিন্ন দেশ থেকে ভক্তরা আসেন। তখন গ্রামবাসী ও মাদ্রসা কর্তৃপক্ষ আমাদের নিরাপত্তা ও সেবা দিয়ে থাকেন।

মুরাদনগর জামিয়া ইসলামিয়া মুজাফফারুল উলূম মাদ্রসার প্রিন্সিপাল ও শাইখুল হাদিস মুফতি আমজাদ হোসাইনের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহপাক ও রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বিধর্মীদের জান-মাল ও আব্রু হস্তক্ষেপের অনুমতি কোথাও দেননি বরং তাদের জান-মালের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটালে তা হবে ইসলামী শিক্ষার বিপরিত কাজ। রাসূল (সা:) বলেছেন, প্রকৃত মুমিন সে, যার অনিষ্ট থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকবে। সুতরাং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায়ে চলার কোন বিকল্প নেই।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন এফসিএ’র কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ ডাক্তার মানবেন্দ্র নাথ সরকার বঙ্গবন্ধু কৃষি ও সাদা মনের মানুষ হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তিনি বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেন এবং আমার জানা মতে তিনি এই পর্যন্ত পাঁচ লক্ষাদিক মানুষকে সেবা দিয়েছেন। অপর দিকে উপজেলার বেসরকারী এতিম কল্যাণ পরিষদের সেক্রেটারী ও হেজাজীয়া এতিমখানা এবং হাফেজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক কাজী লোকমান বড় মনের অধিকারী। এ দুই প্রতিষ্ঠানের মাঁঝ খানে একটি ওয়াল থাকলেও তাদের মানসিকতায় কোন দেয়াল নেই। আশ্রমের আগমনী উৎসবে আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়, আমি সে অনুষ্ঠানে যাই। আবার প্রায়ই আমি ওই এতিমখানার ছাত্রদের সাথে দুপুরের খাবার খাই। তাদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে তা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।

লেখক: মোমিন মুল্লা 

মুরাদনগর, কুমিল্লা।