চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় জড়িত থাকা সন্দেহে এবং ভাবষ্যতে এ ধরনের সহিংস পরিস্থিতি মোকাবেলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ । বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকাল ৪টার দিকে এই প্রজ্ঞাপন জারি করে গেজেট প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৪১ সালে পাকিস্তানের লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৮৩ বছরে এ নিয়ে চতুর্থবারের মত নিষিদ্ধ হল দলটি । এর আগে ১৯৫৭ ও ১৯৬৪ সালে দুইবার নিষিদ্ধ করেছিল পকিস্থান সরকার । স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে অপব্যবহার আখ্যা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) এস.আর.ও নম্বর ২৮০- আইন/২০২৪ - সরকার Commissions of Inquiry Act. 1956 (Act No. VI of 1956) এ-র section 3 এ-র প্রদত্তক্ষমতাবলে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সারাদেশে চলমান পরিস্থিতি তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তিন সদস্যের কমিটির মাধ্যমে তদন্তের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে । তিন সদস্যের কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভারে বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামান অপর দুই সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভারে বিচারপতি এ কে এম জাহিদ সারোয়ার ও শওকত আলী চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে , যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।
১৯৭৬ সালের ৩মে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন রাষ্ট্রপতি এসএম সায়েম তখন সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন জিয়াউর রহমান ফলে আবারও রাজনীতিতে সুযোগ পায় জামায়াত। ১৯৮৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকারে অধীনে নির্বাচনে ১০ আসন পায় তারা। ১৯৯১১ সালে নিজেদের ইতিহসে সর্বোচ্চ ১৮ টি আসনে জয়ী হয় জামায়াত । তদের সমর্থনে সরকার গঠন করে বিএনপি। পরে তত্বাবধায়ক সরকারে দাবিতে আওয়ামীলীগের সাথে যুগপদ আন্দোলনে যোগ দেয় তারা । ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগ সে নির্বাচনে মাত্র ৩টি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী । ২০০১ সালে বিএনপির সাথে চারদলীয় জোটের সঙ্গী হয় এবং মোট ১৭ টি আসনে জয়ী হয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মন্ত্রীত্ব আর্জন করে দলটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ২টি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী। সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করলে অনেকটা চাপে পরে তারা । ফলে একে এক আটক হয় দলটির শীর্ষ পর্যায়ের সকল নেতারা । কার্যকর হয় তাদের ফাঁসি। ২০১৩ সালে সংবিধানের সঙ্গে গঠননতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষনা করে হাইকোর্ট। ২০২৩ সালে এ রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
বিরাজমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী সহিংসতা পর্যালোচনায় গত ২৯ জুলাই (সেমবার) গণভবনে বৈঠক করে ১৪ দল। বৈঠকে উপস্থিত ১৪ দলের নেতাদের মধ্য থেকে প্রস্তাব আসে জামায়াত নিষিদ্ধের। পরে তা আশ্বস্থ করেন সরকার প্রধান। যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমন্বয়ে তিন সদস্যদের কমিটি গঠন করে গত ১ আগষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
সরকারের এই প্রজ্ঞাপনের প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির পৃথক পৃথক বিবৃতি প্রদান করছেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সদ্য নিষিদ্ধ দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কে নির্বাহী আদেশবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে।’’ জামায়াত আমির উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াতের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির উদ্ভাবক জামায়াতে ইসলামী। এই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে পরপর তিনবার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘সরকার বিগত ১৬ বছর যাবত জামায়াতের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছে। জামায়াত ধৈর্যের সঙ্গে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান সব নাগরিককে সভা-সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে। সরকার ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। আমরা সরকারের এই অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’’
নিজ দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে জামায়াতের আমির বলেন ‘সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই জামায়াতে ইসলামীর মূল কাজ ইসলামের দাওয়াত, মানুষের চরিত্র সংশোধন ও ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ কখনও বন্ধ হবে না,’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সর্ব স্তরের জনশক্তিকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আহ্বান জানান ডা.শফিকুর রহমান।
অপর এক বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ সরকারের অবৈধ আদেশ জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে ছাত্রশিবির
সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় অবৈধ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশের জনগণ মানে না।
যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন “১৯৭৭ সাল থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের প্রতিটি সেক্টরে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক উপহার দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সুন্দর একটি সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিটি জনশক্তি জালেমের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। গঠনমূলক কাজ, উন্নত নৈতিক চরিত্র ও ইসলামের সুমহান আদর্শের অনুসরণের মাধ্যমে এ কাফেলা আপামর ছাত্রজনতার আশা-ভরসার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সরকারী সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের আকৃষ্ট হয়েছে।
এছাড়াও জোটের শরীক অন্যান্য রাজনৈতিক দলও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রমাণ করেছে এই দেশে এখন আর কোন গণতন্ত্রের চর্চা নাই। আমরা ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।পরে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন জোট প্রধান এবং জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপা‘র সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ জাতীয় দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো: সারওয়ার আলম, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রকিব, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম, নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি মাস্টার এম এ মান্নান ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল এর চেয়ারম্যান ফিরোজ মোহাম্মদ লিটন।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সংবিধান পরিপন্থী বলে বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর লেবার পার্টির ঢাকা উত্তরের সভাপতি এস এম ইউসুফ আলী, সাধারন সম্পাদক আরিফ সরকার ও ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা আনোয়ার হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহিদুল ইসলাম এবং মোঃ মনির হোসেন খান স্বাক্ষরিত (প্রচার সম্পাদক) লেবার পার্টির নেতারা।