লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার রামগতিতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযানে ১ম দিনের অভিযানে ৩টি ইটভাটায় এক লাখ করে ৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায়, গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সকল সরঞ্জাম।
চররমিজ ইউনিয়নে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ২৮টি ইটভাটা। এর মধ্যে একটি ওয়ার্ডেই গড়ে উঠেছে ১৪টি ইটভাটা। এসব ভাটায় উঁচু চিমনি ব্যবহার করা হলেও কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এমনকি বেপরোয়া ট্রাক্টরের কারণে চলাচলের রাস্তা অচল হয়ে পড়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে ওই ওয়ার্ডের ১৫ হাজার বাসিন্দার।
সম্প্রতি চররমিজ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪টি ইটভাটার মধ্যে রফিক ব্রিকস ও আশরাফ ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী জানিয়েছেন, তাদের ভাটাগুলোর বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিন ইটভাটার মালিক জানিয়েছেন, তাদের ইটভাটার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তাদের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরপরও তারা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ভাটা তৈরি করেছেন। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাহিদ হোসেনসহ কয়েকজন তাদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন। তাদের যোগসাজসেই ভাটাগুলো চালানো হচ্ছে।
চররমিজ ইউনিয়নের আজাদ মেমোরিয়াল সড়ক ও সৈয়দ মৌলভি চৌধুরীর হাট সড়কের দুটি ইটভাটায় সরেজমিনে দেখা যায়, ইট পোড়ানোর জন্য ভাটাগুলো তৈরি করা হচ্ছে। কয়েকশ মণ কাঠ ভাটা এলাকায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক স্তূপ থেকে মাটি কেটে পানি দিচ্ছেন। আর অন্যরা ইট তৈরির কাজে ব্যস্ত। প্রতিদিন ১০০ টাকা বেতনে শিশুরা ইট শুকানোর কাজ করে। কেউ কেউ মৌসুম অনুযায়ী নির্দিষ্ট একটি বেতন নিয়ে কাজ করছে। নভেম্বর থেকে পুরো শুষ্ক মৌসুমজুড়ে কর্মযজ্ঞ চলবে।
রফিক ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী রফিক উল্যার ছেলে মিজানুর রহমান জানান, তার ভাটার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তিনি ছাড়াও চররমিজের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১৪টিসহ পুরো ইউনিয়নের ২৮টি ভাটা অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। কয়লার পরিবর্তে সব ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর গেলবার ২ লাখ টাকা তাদের জরিমানা করেছে। পরে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ডাকা হলে তারা অনুমতির জন্য আবেদন করেন। তার দাবি, যদি অন্য ২৭টি ভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে তারটাও বন্ধ করা হবে। এবার তারা ৫০ লাখ ইট তৈরি করবেন বলে জানিয়েছেন।
আশরাফ ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী মো. আশরাফ ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি জানিয়েছেন , ইউনিয়নের অন্য ২৭টি ইটভাটার মতো তারটিও চলছে। ভাটা চালাতে তার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। অন্য কোনো বৈধ কাগজপত্রও নেই। খুব শিগগিরই ভাটায় ইট পোড়ানো হবে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম নিজাম বলেন, প্রতিটি ইটভাটায় অন্তত ২০ একর জমি প্রয়োজন হয়। ফলে ১৪টি ইটভাটা একটি ওয়ার্ডের অধিকাংশ জমি দখল করে আছে। এতে ভাটার ধোঁয়ার কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টন কার্বন ডাই অক্সাইড গিলে খাচ্ছে। মানুষের শ্বাসতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জমির উর্বর মাটিগুলো ইটভাটায় চলে যাচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আশরাফ আলী চৌধুরী বলেন, আমি চররমিজের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এখানে ১৪টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কেটে ইট তৈরি করা হচ্ছে। এতে কয়েক বছর ওই জমিতে ফসল চাষ বন্ধ রাখতে হয়। ভাটার ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অবৈধ হওয়া শর্তেও ভাটাগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না।
২৮ ইটভাটার কথা স্বীকার করে চররমিজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজাহিদুল ইসলাম দিদার বলেন, ভাটার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সম্প্রতি একটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়। ইটভাটার কারণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ নানাভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছে।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাহিদ হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। ভাটার মালিকরা কেন আমাকে টাকা দিতে যাবে?
তিনি আরও বলেন, চররমিজ ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নেও অনেকগুলো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও ইটভাটা গুড়িয়ে দেয়। ফের ভাটা মালিকরা ইট পোড়াতে শুরু করে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ভাটাগুলো বন্ধ করতে পারে।
লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, সম্প্রতি এ জেলায় আমরা দায়িত্ব পেয়েছি। এর মধ্যেই আমরা কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে অভিযান চালিয়েছি। জরিমানাও করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত দিলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। আমাদের অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
রামগতি উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তা এসএম শান্তুনু চৌধুরী বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশনায়
রামগতি উপজেলায় লাইসেন্সবিহীন ব্রিক ফিল্ডসমূহে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী "গিয়াসউদ্দিন ব্রিক্স", "রফিক ব্রিক্স" এবং "এম এস ব্রিক্স" এর প্রত্যেককে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা করে মোট ৩,০০,০০০ (তিন লক্ষ) টাকা অর্থদন্ড প্রদান করা হয়। পাশাপাশি এগুলোর চিমনীসমূহ উপড়ে ফেলা হয় এবং চুল্লীর আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খাঁন। এ সময় সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন ফায়ার সার্ভিস, রামগতি এবং রামগতি থানা।
তিনি এই সময়ে বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে সোমবার (১৪ নভেম্বর) থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু হয়েছে। কেউ আমাদের থেকে অনুমতি নিয়ে ভাটা শুরু করে না। এজন্য অবৈধ ভাটাগুলোতে ইট তৈরি শুরু হয়েছে কি না তা আমাদের জানা থাকে না। কিন্তু অবৈধ ইটভাটা ও বাংলা চিমনি ব্যবহাকারীদের খবর পেলেই আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। কিছু দিন আগেও একটি ভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ ভাটা মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় কি না তা আমার জানা নেই। কেউ আমার কাছে অভিযোগও করেনি। অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।