ঢাকা, শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সহকর্মীকে বাঁচাতে যেয়ে প্রাণ হারানো জায়েদের

লাশের অপেক্ষায় পাঁচ মাস স্বজনহারাদের আহাজারি।

মোঃওয়াহিদুর রহমান মুরাদ : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১ নভেম্বর ২০২২ ০৭:১৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নন্দীগ্রামের জমাদ্দার বাড়ির সৌদি আরবে কর্মস্থলে মারা যাওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস পার হলেও জায়েদ (২৬) নামে এক যুবকের মরদেহ এখনো দেশে আনা হয়নি। জায়েদের অসুস্থ বাবা ইউসুফ মিয়াসহ পরিবারের লোকজন মরদেহটি লক্ষ্মীপুরে আনার জন্য আকুতি জানিয়েছেন। তার মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। 
 
 বক্তব্য দিতে না পারলেও কান্নায় মূর্ছা যাচ্ছিলেন জায়েদের পিতা । এ সময় বাবার সঙ্গে কান্না করছিলেন জায়েদের বড় বোন মারজাহান আক্তার। তাদের দুজনের কান্নায় যেন বাড়ির আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। 
 
জানা গেছে, জায়েদ শ্রমিক ভিসায় ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি চাকরির উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে যান। তার পাসপোর্ট নম্বর- বিএম ০৮৭৯৪৫৮। এর আগে তিনি ঢাকায় একটি ব্যাগের কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর তাদের মরদেহ দেশে আনার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়।
 
পরিবারের লোকজন জানান, সৌদিতে জায়েদ একটি পানি সাপ্লাইয়ের কোম্পানিতে কাজ করতেন। গত ২৩ মে জেদ্দা শহরের ম্যানহলে কাজ করতে যান জায়েদ ও তার সহকর্মী নজরুল। প্রথমে নজরুল ম্যানহলে নামেন। এতে অক্সিজেন সংকটে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। ম্যানহলের ভেতর থেকে নজরুল বাঁচার জন্য জায়েদের সহযোগিতা চান। এতে নজরুল তাকে বাঁচানোর জন্য ম্যানহোলে ঢোকেন। সেখানে তিনি নিজেও অক্সিজেনের অভাবে মারা যান। অনেক সময় পার হলেও দুজনের কেউই ম্যানহোল থেকে বের হচ্ছেন না। পরে সেখান থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মরদেহ প্রায় সাড়ে ৫ মাস ধরে সেখানে জার্মান হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষিত রয়েছে।
 
জায়েদের ভাই ওমান প্রবাসী আবদুল আউয়াল বলেন, জায়েদের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার কোম্পানি ও সেখানে আমাদের পরিচিত লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। মরদেহ ফ্রিজে রাখা আছে বলে তারা জানিয়েছেন। পরবর্তীতে মরদেহ দেশে আনতে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে (অ্যাম্বাসি) যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শোনেনি। এখনো আমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে আনা হচ্ছে না। আমার অসুস্থ বাবাসহ মা ও বোন সবাই প্রতিদিন তার জন্য কান্না করছেন। মরদেহটি দেশে এনে দাফন না করা পর্যন্ত তাদের কান্না থামবে না। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমার ভাইয়ের মরদেহটি যেন দ্রুত দেশে এনে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
 
জায়েদের বোন মারজাহান আক্তার বলেন, কুমিল্লার নজরুল ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে আমার ভাইও মারা গেছেন। দেশে ছুটিতে এসে তার বিয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু আজ তার মরদেহ সৌদির হাসপাতালে ফ্রিজিং করে রাখা হয়েছে। দুইবার মরদেহ দেশে আনার তারিখ দিয়েছিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা আমার ভাইয়ের মরদেহ আনেনি। আমরা কী আমার ভাইয়ের লাশটাও পাব না? এসব বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। 
 
জায়েদের মা খুকি বেগম বলেন, জীবিত অবস্থায় ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছি। সেখানেই ছেলেটি মারা গেল। সাড়ে পাঁচ মাস হয়ে গেল তার মরদেহ দিচ্ছে না তারা। তাকে তো আর জীবিত দেখব না, লাশটা পেলে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। আমার বাবার লাশটা দয়া করে আপনারা এনে দেন।
 
বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) নোমান হোসেন দুলাল বলেন, মরদেহ দেশে আনার জন্য আমরা সকল কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছি। ওই কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে সৌদিতে বাংলাদেশি দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু জায়েদের মরদেহ এখনো দেশে আনা হয়নি। তার মরদেহ দ্রুত দেশে আনতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
 
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের যুগ্ম-সচিব শোয়াইব আহমাদ খান মুঠোফোনে বলেন, মরদেহ আনার জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল। ২ অক্টোবর আমরা সৌদি আরবের জেদ্দায় কনস্যুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশ কাউন্সিলরের (শ্রম) কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। সেখান থেকে তারা চিঠি ফেরত পাঠিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী দুই মাস পর আবার চিঠি পাঠাতে হবে। তবে আমরা এর আগেই চিঠি পাঠিয়ে মরদেগুলো দেশে আনার জন্য চেষ্টা করব।