সিলেট-২ আসনে (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমানকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি এবং প্রতীক বরাদ্দ দিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেননি আপিল বিভাগ।
মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন ও এক প্রার্থীর করা আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার ড. মুহাম্মদ ইয়াসিন খান। ওই আসনের বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী মো. জহিরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খায়রুল আলম চৌধুরী। মুহিবুর রহমানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক, সঙ্গে ছিলেন এম মঞ্জুর আলম।
মঞ্জুর আলম জানান, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশের উপর কোনো হস্তক্ষেপ না করায় মুহিবুরের নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই।
গত বছরের ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পৌরনির্বাচনে সিলেটের বিশ্বানাথে প্রথম পৌরমেয়র নির্বাচিত হন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও দুইবারের উপজেলা চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জগ প্রতীক নিয়ে ৮ হাজার ৪৭৪ ভোট পেয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফারুক আহমদ নৌকা প্রতীক নিয়ে পান ৩ হাজার ২৬৩ ভোট।
পৌরমেয়র নির্বাচিত হওয়ার ১ বছরের মাথায় তিনি সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ আসন থেকে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। তবে ইলেকশন কমিশনের ‘স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পদ ছেড়ে প্রার্থী হতে হবে’ এই নির্দেশনাকে অমান্য করে মেয়র পদে বহাল থেকে মুহিব মনোনয়ন কিনেন। ফলে যাচাই-বাছাইয়ে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। তবে নাছোড়বান্দা মুহিব প্রার্থিতা ফিরে পেতে ইলেকশন কমিশনে গত ১০ ডিসেম্বর আপিল করেন। পাঁচ দিন পর আপিলটি খারিজ করে দেয় ইসি।
এরপর প্রার্থিতা ফেরাতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন মুহিবুর রহমান। তার দায়েরকৃত রিটের শুনানির ধার্য্য তারিখে (২০ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেল আমীর উদ্দিন অংশ নিয়ে এর বিরোধিতা করেন। পরে বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও ইকবাল করিম’র যৌথ বেঞ্চ রিটের আদেশের জন্যে ২৭ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করেন। কিন্তু এর দুইদিন আগে (২৪ ডিসেম্বর) রিটের আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে বিচারপতি মো. ইকবাল কবির এবং বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ মুহিবের প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
হাইকোর্ট মুহিবের প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিলেও ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেটি লিখিত আকারে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে এসে পৌঁছেনি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়নি মুহিবকে।
এদিকে, প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নামার সুযোগ না থাকলেও ২৫ ডিসেম্বর থেকে বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগরের বিভিন্ন স্থানে ‘ট্রাক’ প্রতীকসম্বলিত মুহিবুর রহমানের নির্বাচনি প্রচারণার পোস্টার সাটানো দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন গাড়িতেও লাগানো দেখা যায় এমন পোস্টার। এই নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২৬ ডিসেম্বর বিকালে বিশ্বনাথ উপজেলা পৌরপ্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মুহিবকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
অর্থদণ্ড পেয়েও থামেননি মুহিবুর রহমান। ২৭ ডিসেম্বর দুপুর থেকে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত তাঁর পক্ষে বিভিন্ন স্থানে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। এছাড়া তিনিও বিশ্বনাথের বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ এবং লিফলেট বিতরণ করেন। এগুলো মুহিব তার ফেসবুক আইডিতে প্রচারও করেন।
অন্যদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশনার ৪ দিন পরও প্রতীক বরাদ্দ না পেয়ে আন্দেলনে নামেন মুহিবুর রহমান। ২৮ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা শেখ রাসেল হাসানের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন মুহিব ও তাঁর কর্মী-সমর্থকরা। এসময় সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় এবং মুুহিবের সমর্থকদের হাতে প্রতীক বরাদ্দের দাবিসংবলিত বিভিন্ন ধরণের প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
প্ল্যাকার্ডগুলোতে লেখা ছিলো- ‘জেলা প্রশাসকের অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ কর’, ‘হাইকোর্টের আদেশ মানতে হবে’, ‘অযোগ্য নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চাই’, ‘২৪ শে ডিসেম্বর হাইকোর্ট প্রার্থিতা বহালের রায় দিলেও এখন পর্যন্ত প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়া ষড়যন্ত্র নয় কি?’, ‘নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়’ ইত্যাদি।
পরে জেলা প্রশাসকের অনুরোধে কার্যালয় প্রাঙ্গণ ছেড়ে সড়কে অবস্থান নেন মুহিব ও তার সমর্থকরা। এসময় মুহিব উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন- নির্বাচন কমিশন নিরপক্ষ ভূমিকা পালন করছে না। যে কারণে আদালতের নির্দেশনার পরও আমাকে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।
এখানে প্রায় ২ ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন মুহিব তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বিশ্বনাথ পৌরশহরে চলে যান। সেখানে তারা মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে বক্তব্য প্রদানকালে মুহিব বলেন- আজ (২৮ ডিসেম্বর) বিকালের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ না দিলে শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করা হবে।
তবে সেপথে হাঁটতে হয়নি মুহিবকে। ওইদিন রাতেই উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুহিবুর রহমানকে তাঁর পছন্দের প্রতীক ‘ট্রাক’ বরাদ্দ দেয় ইলেকশন কমিশন।
ভোটের মাত্র ৯দিন প্রতীক পেলেও স্বস্তিতে ছিলেন না মুহিব। তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও ওই আসনের এক প্রার্থীর পৃথক আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) শুনানির দিন ধার্য্য করেন। অবশেষে সেই বাধাও পেরিয়ে গেছেন মুহিব। এখন দেখার পালা- উপজেলার কতটি ভোট তিনি নিজের ব্যাংকে জমা করতে পারেন।
মুহিবের প্রার্থিতা বহাল থাকায় সিলেট-২ আসনে শেষ পর্যন্ত লড়ছেন ৭ জন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুর রহমান চৌধুরী (নৌকা), গণফোরামের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোকাব্বির খান (উদীয়মান সূর্য), বিশ্বনাথ পৌরমেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান (ট্রাক), জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইয়াহইয়া চৌধুরী (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুর রব (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী মো. জহির (ডাব) এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) প্রার্থী মো. মনোয়ার হোসাইন (আম)।