ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সিলেটি মা: মায়ের ইচ্ছা পূরণ

এমএ রহিম, সিলেট: | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ১২:২২:০০ পূর্বাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সিলেটের বিশ্বাসযোগ্য এক নেতা। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র। ধীরে চলো নীতিতে এগিয়ে চলেছেন। নগরবাসীর সমস্যার স্থাীয় সমাধানে বদ্ধপরিকর। নগরবাসীর সেবায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছুটে চলা এই নেতা সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম তিলাপাড়া গ্রামে ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই গর্ভধারিনী মায়ের আদেশ, উপদেশ পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে। মায়ের ইচ্ছে পূরণে নিজকে সব সময় নিয়োজিত রেখেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মায়ের ইচ্ছে পূরণ করার প্রতিজ্ঞা রয়েছে মনের ভেতর। সে অনুযায়ী কাজ করে চলেছেন অবিরাম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী পরবর্তীতে যুবলীগের ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন যুক্তরাজ্যে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নৌকা প্রতীক দিয়ে সিলেটবাসীর কাছে পাঠিয়েছিলেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। ২০২৩ সালের ২১ জুন বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। এই চলার পথে মমতাময়ী মায়ের বিশাল প্রভাব রয়েছে আনোয়ারুজ্জামানের উপর। শৈশব থেকে এ পর্যন্ত পথ চলার পথে মায়ের প্রভাব সম্পর্কে জানিয়েছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানান, ‘মায়ের ছায়া যেন সার্বক্ষণিক আমার চারপাশে বিরাজ করে।  অবিরাম ছুটে চলেছি মমতাময়ী ওই মায়ের ইচ্ছা পূরণে। প্রতিটি ধাপে মায়ের ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। কোনো ব্যর্থতা নেই। মানব সেবায় নিজকে উৎসর্গ করতে পারছি। যেমনটি চাইতেন, চাচ্ছেন মা। মানব সেবার কাজে হাত দেওয়ার আগে দোয়া প্রার্থী হই মায়ের কাছে। মায়ের দোয়া নিয়ে প্রতিটি কাজে সহজেই সফলতা লাভ করতে সক্ষম হই। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ আমার মায়ের বয়স ১০০ বছরের উপরে। আমার বয়স ৫৩ বছর। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে মায়ের আদর্শ দেখে আসছি। তিনি একজন পরহেজগার মা। কঠোরভাবে ধর্মপ্রাণ। ফজর নামাজের সময় মুয়াজ্জিনের আজান কানে ভেসে আসা মাত্র মা জেগে উঠতেন। নিজে নামাজ পড়তেন। পরিবারের যারা নামাজের জন্যে উপযুক্ত তাদেরকে জাগিয়ে তুলতেন। নামাজ পড়তে বাধ্য করতেন। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কোনো অবস্থাতেই কাজা করেন না মা। অনেক সময় দেখেছি গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে। তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে চোখের পানি ফেলে দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেন। মুনাজাতের কাকুতি আর ফরিয়াদ যেন আমার ৬ ভাইয়ের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। যার প্রমাণ আমি নিজে। আমি যেদিকে হাত বাড়াই সেদিকেই সফলতা পাই। সরাসরি দোয়া চাইতে মায়ের সামনে হাজির হলে কপালে চুমু দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। মায়ের দোয়া ব্যর্থ নয়-তা আমার জীবনে প্রমাণিত।’

মায়ের দৈনন্দিন রুটিন

মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘মায়ের দৈনন্দিন রুটিন নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়। সূর্য উঠার সাথে সাথে আরবি পড়তে যাওয়ার জন্যে তাগাদা দেয়া হতো। তার আগে নাস্তা খেয়ে নিতাম। দুই ভাবী ছিলেন। তাঁরা তৈরি করতেন নাস্তা। তিলাপড়া শাহী ঈদগাহ মসজিদের মক্তবে গিয়ে আরবি পড়তে হতো। আরবি পড়া সম্পূর্ণরূপে তদারকি করতেন মা। আরবি অক্ষর শেখার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রথম পড়াশোনা শুরু হয়। আর এই আরবি অক্ষর শিখিয়েছিলেন মা। অত্যন্ত যতœসহকারে আরবি অক্ষর শেখানোর কাজ করেছিলেন। নামাজ পড়তে শেখানো হয়েছিল মক্তবে। বাড়িতে একান্তভাবে তা পরীক্ষা করেছেন মা। মক্তব শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল পশ্চিম তিলাপাড়া সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম অপেক্ষা করছেন মা। কাছে এগিয়ে এসে কপালে চুমো খেতেন। হাত বুলিয়ে দিতেন মুখে। পরম শান্তি নেমে আসত মায়ের হাত বুলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে। সেই শৈশবকালেই ফুটবল খেলার প্রতি ঝোক ছিল। খাওয়া শেষে ছুটে যেতাম মাঠে। ফুটবল খেলতে খেলতে সন্ধ্যা নেমে আসত। মাগিরেব আজানের আগেই ঘরে ফেরার চেষ্টা করতাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখতাম। কঠিন শাস্তি হিসেবে উত্তম মাধ্যমের শিকার হতাম। তবে মা যেমন কঠোর, তেমনি নরম হৃদয়ের প্রাণের মা। ভালো কাজ করলে আদর সোহাগের কমতি হতো না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হওয়া বাংলা পড়া শেষ হতো রাত ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে। রাতের খাবার শেষে ঘুমের আয়োজন করে দিতেন মা। মশারি টানিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতেন। ঘুম পাড়াতে হাত বুলিয়ে দিতেন মাথায়। মায়ের পাশে ঘুমাতাম আমি। আমি ঘুমিয়ে পড়লে ঘুমাতেন মা। পরম শান্তির ঘুম।’

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ আমার এই মমতাময়ী গর্ভধারিণী মা হলেন মোছা. গহিনুন্নেছা চৌধুরী। বয়স ১০০ বছর অতিক্রম করেছে। এখনও নিয়মিত নামাজ পড়েন পাঁচ ওয়াক্ত। কোরআন শরীফ তেলওয়াত করেন। মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত সবসময় উন্মুক্ত। বাবা নৌশা মিয়া চৌধুরী ১৯৭৮ সালে ইন্তেকাল করেছেন। তখন আমার বয়স ছিল ৮ বছর। বাবা বসবাস করতেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে ব্যবসা করতেন। অসুস্থ হওয়ার পর বাবা দেশে আসেন। আমাদের বিশাল বাড়িতে হেঁটে বেড়াতেন। বাবার আঙ্গুল ধরে আমিও হেঁটে বেড়াতাম। দেখতাম বাবা বাড়ির বিভিন্ন ফলজ গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করছেন। তা তুলে দিচ্ছেন প্রতিবেশিদের হাতে। বাবার ওই কর্ম আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। এখন মানুষের হাতে কিছু তুলে দিতে পারলে তৃপ্তি পাই। অন্তরে নেমে আসে প্রশান্তি।’

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭০ সালের ১ জুলাই সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গাবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম তিলাপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ৬ ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ তিনি। বড় ভাই  হাবিবুর রহমান সালিক চৌধুরী, আওলাদ হোসেন চৌধুরী, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদাল হোসেন চৌধুরী, আজাদ বখত চৌধুরী ও আনহারুজ্জামান চৌধুরী। সবাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী। সেদেশে সুনামের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করেন। প্রতি বছর দেশে মোটা অংকের বৈদেশিক মূদ্রা পেরণ করেন।

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাসের পর সিলেট সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। পরে তিনি লন্ডন গিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে আসক্ত হয়ে পড়েন। হাইস্কুলে অধ্যায়নকালীন পুরোপুরি  ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ওই সময়টা ছিল এরশাদ সরকারের আমল। আন্দোলনে উত্তাল ছিল দেশ। আনায়ারুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে গ্রামীণ জনপদ বুরুঙ্গায়। পরবর্তীতে অবিভক্ত বালাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সমাজসেবা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নব্বইয়ের দশকে প্রবাসে পাড়ি জমিয়ে তিনি যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। তিনি প্রথমে লন্ডন মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য হিসেবেও মনোনীত হন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বিভিন্ন সময় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০২৩ সালের ২১ জুন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী হলি বেগম চৌধুরী ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেস - এনএইচএস এ হেলথ আইনজীবী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে।

সহপাঠিদের প্রতি মায়ের উদারতা

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ আমার মা সম্পূর্ণভাবে অহংকারমুক্ত। শৈশব থেকে দেখে আসছি মায়ের ভেতরে বিন্দু মাত্র অহংকার নেই। সব শ্রেণির মানুষের সাথে সহজেই মিশে যান। সকলকে দেখেন সমান চোখে। মর্যাদার মাপকাঠিতে ধনী গরীব হিসেবে মানুষকে কখনও দেখেননি। স্কুল জবানায় ছাত্র রাজনীতি করার সময় সহকর্মীরা আমাদের বাড়িতে আড্ডা জমাতেন। সব সময় সহকর্মীদের আনাগোনা লেগে থাকত আমাদের বাড়িতে। সহকর্মীদের আনাগোনায় কোনোদিন বিরক্ত হননি মা। আমার সহপাঠিদের আপ্যায়নের ব্যাপারে মা ছিলেন আন্তরিক। গৃহপরিচারিকাদের উপর নির্দেশনা ছিল, আমার সহপাঠিদের আপ্যায়িত করার সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের। মায়ের নির্দেশনা কার্যকরে গৃহপরিচারিকারা সতর্ক থাকতেন। বুঝতাম মায়ের সমর্থন রয়েছে আমার কাজে। শৈশব থেকেই মা স্বপ্ন দেখতেন আমাকে নিয়ে। সুসন্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করি-এমনটা কাম্য ছিল। মাঝে মাঝে মা বলতেন-তোকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। মায়ের এই ইচ্ছা কিভাবে পূরণ করব তা নিয়ে কৈশোর বয়স থেকে ভাবতাম। সতর্ক থাকতাম মায়ের অবাধ্য যেন না হই। মায়ের ইচ্ছে পূরণে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতিও করতে থাকি। বাবার মৃত্যুর পর বৃটিশ সরকারের অবসর ভাতা পেতেন মা। ওই অবসর ভাতার সিংহভাগ আমার হাতে দিয়ে দিতেন মা। এই টাকা ব্যবহার করতাম রাজনীতির মাঠে। দেখতাম তাতে কোনো আপত্তি করছেন না মা। বুঝতে পেরেছিলাম-আমার কর্মকান্ডে মায়ের সমর্থন আছে। এতে আরো ঝুকে পড়লাম রাজনীতিতে। কলেজ জবানায় ভাবতাম গৌহাটি বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করব। একসময় সেই ইচ্ছের বিলুপ্ত ঘটে। যুক্তরাজ্যে চলে যাই উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে। সেখানে সর্বশেষ গ্রিনউইচ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করি। সেখানে অধ্যায়নের সময় যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করি নিজকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে যুক্তরাজ্যের বাঙালি কমিউনিটির সাথে যোগাযোগ সুদৃঢ় করে তুলি। প্রতিটি কাজের প্রথমেই মায়ের দোয়া চাইতাম। মা দোয়া করতেন প্রাণখুলে। সতর্ক হয়ে চলার নির্দেশ দিতেন। এতে আরো পরিষ্কার হয়ে উঠে মায়ের ইচ্ছে। প্রকাশ পায়, তিনি চাইতেন মানসেবায় আমি যেন এগিয়ে যাই। আমি নিজেও ভাবলাম মানবসেবার বড় প্লাটফর্ম হচ্ছে রাজনীতি। আর বাংলাদেশের অসহায় মানুষের সেবা করার বড় প্লাটফর্ম হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এই রাজনীতিতে নিজকে উৎসর্গ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। মায়ের দোয়ায় সফল হচ্ছি। ইচ্ছা পূরণও হচ্ছে মায়ের।  

মায়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত

বিয়ে প্রসঙ্গ টানতেই সিলেট নগরীর সেবক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ৬ ভাইয়ের সংসার পুরোপুরি মায়ের নিয়ন্ত্রণে। যেকোনো কাজ করতে হলে অবশ্যই মায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। মা সিদ্ধান্ত দিলে বাস্তবায়িত হবে কাজ। আমার বড় ৫ ভাইয়ের জন্যে কনে দেখেছেন মা। পছন্দ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন মা। তার পর বিয়ে হয়েছে। একই রেওয়াজে আমার বিয়ে হয়েছে। মা কনে দেখেছেন। পারিবারিকভাবে বসে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন মা। তারপর আমার বিয়ে হয়েছে যুক্তরাজ্যের মাটিতে। আমার তিন সন্তান লন্ডনে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা নিয়ে তারা খুবই ব্যস্ত থাকেন। ছুটির দিনে তারা তাদের দাদির সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ছুটির দিন দাদির কাছে যেতে হবে অবশ্যই। অন্যথায় কুরুক্ষেত্র। কারণ তারা তাদের দাদিকে অনেক পছন্দ করেন। তাদের চাহিদার তালিকার প্রথমেই রয়েছে দাদির সাথে সময় কাটানো। দাদিও (আমার মা) তাদের জন্যে অপেক্ষায় থাকেন। কাছে পেলে আদর যতেœর কোনো কমতি থাকে না। সে দৃশ্য অসাধারণ। শুধু আমার সন্তান নয়। আমার ৫ ভাইয়ের সন্তানরাও দাদির সানিধ্য পাওয়ার জন্যে আকুল থাকেন।’

আনোয়ারুজ্জামান বলেন, ‘পেছন ফিরে আবার বলতে হয়, শৈশব থেকে দেখে আসছি সংসারে মায়ের একক আধিপত্য। ৫ ভাই বিয়ে করেছেন ধারাবাহিকভাবে। মা দেখেছেন কনে। পছন্দ হওয়ার পর সকল ভাইকে নিয়ে পারিবারিকভাবে বৈঠকে বসতেন মা। ওই বৈঠকে মা জানাতেন সিদ্ধান্ত। মায়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হতো। এখানেই শেষ নয়। ব্যবসা বাণিজ্যসহ পারিবারিক নানান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মা। আর এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সকল ভাইকে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হয়। আর মায়ের সিদ্ধান্তে কাজ করি আমরা। ব্যর্থতা নেই। সর্বত্র সফলতা।’

দাবি পূরণে উদার মা

শৈশবে মায়ের কাছ থেকে দাবি আদায়ে শিশুরা নানান কৌশল অবলম্বন করেন। শিশুর কৌশলের কাছে পরাজিত হতে হয় মাকে। কিন্তু আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। তিনি জানিয়েছেন, ‘মা আমার মা। অনেক মানবিক। শৈশবকালে আমাকে নজরদারি করার জন্যে দুইজন মানুষ নিযুক্ত ছিলো। বিশাল বড় বাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর সময় নিযুক্ত দুইজন হতেন নিত্যসঙ্গি। বেড়ে উঠার পর যখন যা চেয়েছি, তখন মায়ের কাছ থেকে তা পেয়েছি। মানবিক মায়ের মুখ থেকে কোনো দিন না শব্দ শুনিনি। কারণও আছে। মা জানতেন ফুটবল খেলি আমি। রাজনীতির সহকর্মী, পাড়া প্রতিবেশির সাথে খাওয়া দাওয়ায় টাকা ব্যয় করতাম। সময়মত লেখাপড়া করতাম। এসব কাজে যা প্রয়োজন হতো তাই চেয়ে নিতাম। চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় টাকা বা জিনিস হাতে তুলে দিতেন মা। তিনি এও জানতেন আমি যা করি, তার সবই সমাজের জন্যে ইতিবাচক। নেতিবাচক কোনা কাজে জড়িত ছিলাম না কখনই। তবে শৈশবে মাঝে মধ্যে ২-১ টি ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। চাহিদা অনুযায়ী টাকা বা জিনিস না পেলে মন গম্ভির করে বসে থাকতাম। বাধ্য হয়ে চাহিদা পূরণ করতেন আমার প্রিয় মা।’

মানবিক মা

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার মা ছিলেন মানবিক, এখনো মানবিক। মানবিকতার সকল গুণ রয়েছে মায়ের মধ্যে। কারো কষ্ট দেখলে, কষ্ট পেতেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এখনও তা অব্যাহত আছে। আমার মানবিক কর্মকান্ডকে সবসময় সমর্থ করতেন মা। মানবিক কাজ করতে যা প্রয়োজন, তার সবই যোগান দিতেন। ভালো কাজ করতে গিয়ে যাতে মন খারাপ না হয়, সেদিকে সতর্ক নজর দিতেন।’

মায়ের প্রিয় সন্তান, আদরের সন্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মেয়র আনায়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার মা সম্পূর্নরূপে আদর্শ মা। আদর্শ মা হওয়ার যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার সবই রয়েছে আমার মায়ের মধ্যে। শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে গড়ে উঠে সহজ সখ্য। এতে মায়ের সাথে সব বিষয় শেয়ার করি। ছোট ছোট বিষয় থেকে শুরু করে গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করি। আত্মবিশ্বাসী হতে শিখেছি মায়ের কাছ থেকে। জীবনের বিভিন্ন ব্যর্থতাকে সহজভাবে নিতে শিখিয়েছেন মা। কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সফল হওয়ার আত্মবিশ্বাস গেঁথে দিয়েছেন মা। এও শিখিয়েছেন ব্যর্থ হওয়ার মানে ব্যর্থ নয়।

মতামতে মায়ের গুরুত্ব

তিনি বলেন, মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছেন মা। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে আমার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার মমতাময়ী মা সে কাজটি করতেন না। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মতামত নেন আমার। এতে আমি বুঝতে পেরেছি আমার মতামতেরও মূল্য আছে। ফলে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নতে শিখেছি।

মায়ের নিশর্ত ভালোবাসা

বিভিন্নভাবে মা তাঁর ভালোবাসা আমার প্রতি প্রকাশ করেন। আচরণেও প্রকাশ করেন ভালোবাসা। জড়িয়ে ধরে আদর করেন, চুমু খান। এতে মায়ের সাথে দৃঢ় হয়েছে মানসিক বন্ধন। কখনোই ভালোবাসায় কোনো শর্ত জুড়ে দেন না আমার মা। ভালোবাসা দিয়ে বোঝান যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে তিনি আছেন, থাকবেন। কিভাবে স্বাবলম্বী হতে হয় তাও শিখিয়েছেন মা।  আত্মসম্মানবোধে মা ছিলেন অত্যন্ত যতœশীল। ওই শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন মা। শৈশবে আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন মা। পর্যাপ্ত সময় দিতেন। এখন কর্মব্যস্ততায় ব্যস্ত থাকি। কিন্তু প্রতিদিন একবার কথা না বললে মনে শান্তি আসে না।

তিনি বলেন, আচরণ ও নীতিবোধ শিখেছি মায়ের কাছ থেকে। সামাজিকতা শিখেছি। কীভাবে সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হয়, বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে কীভাবে মেটাতে হয়, উৎসব-অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়Ñ এসব শিক্ষা দিয়েছেন মা। শিখিয়েছেন নীতিবোধ। বড়দের গায়ে পা না দেওয়া, তাঁদের সম্মান করে চলা, মিথ্যা কথা না বলা, কারো ক্ষতি না করা, না বলে অন্যের জিনিস না নেয়াও শিখিয়েছেন পরম মমতায়। অন্যের সঙ্গে আমাকে কখনই তুলনা করতেন না, এখনো করেন না। মা সুযোগ পেলেই প্রশংসা করেন আমার কাজে। মায়ের প্রশংসা আমার ভেতরে আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। শৈশবে ছোট খাটো অন্যায় করলে মা শাসন করতেন। কেন শাসন করেছেন তার জন্যে পরিষ্কার ধারণা দিতেন। এতে আমি মনে করতাম মা যে শাসন করেছেন তা সঠিক।

মায়ের আদর্শ তুলে ধরি সন্তানদের কাছে

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মায়ের কাছ থেকে এখনো শিখছি। এই শিক্ষা, উপদেশ আমার সন্তানদেরও শেখানোর চেষ্টা করছি। তাদের কাছে তুলে ধরি আমার মায়ের আদর্শ। এই আদর্শ তারা গ্রহণ করে সহজে। আমি আমার সন্তানদের উপদেশ দেই। জানিয়ে দেই আমার মায়ের আদর্শের কথা।  

আমার মা ক্ষতি থেকে রক্ষা করার চেয়েও বেশি কিছু করেছেন। এখনো করেন। মা শিখিয়েছেন বেঁেচ থাকার পাশপাশি উন্নতি করার কৌশল। সফল হওয়ার জন্যে মা নানানভাবে উৎসাহীত করেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকারও করেছেন মা। কাঙ্খিত ভালবাসা দিয় নিজের প্রতি যতœশীল হওয়ার নিয়ম শিখিয়েছেন। সমাজ কী ভাবছে এবং আমি কি ভাবছি তা নিয়ে বেশি যতœশীল আমার মা। আনোয়ারুজ্জামান বলেন, এসব বিষয় আমি আমার সন্তানদের কাছে তুলে ধরি।

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সন্তাদের জানিয়ে দেই মা শিখিয়েছেন নৈতিকতা, শিষ্টাচার, সম্মান এবং শৃঙ্খলা। সন্তুষ্ট হয়ে মা প্রশংসা করেন। অনেক সময় চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখেলে মা কারণ জানতে চাইতেন। মায়ের কাছে উদ্বেগের বিষয় সহজেই উপস্থান করতাম, এখনো করি। কারণ মা হচ্ছেন আমার সবচাইতে বড় বন্ধু। আমি মায়ের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এটা আমার আদর্শ মায়ের গুণ। ভালো ও খারাপের মধ্য বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে মায়ের। সেই কৌশল শিখিয়েছেন মা। হাসিমুখ ছাড়া কখনো মাকে দেখিনি। কারণ মা কখনো আমার সামনে কষ্টের বিষয়টি বুঝতে দেননি। কষ্ট লুকিয়ে রাখেন হাসির আড়ালে। একজন আদর্শ মা একটি জাতি গঠনে অবদান রাখেন এবং বিরোধিতা করেন। নজির রয়েছে অনেক। কিন্তু আমার মা জাতি গঠনে আমাকে তৈরি করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার পর এই দুনিয়াতে যদি কেউ থেকে থাকেন তিনি হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীর আলো দেখেন একমাত্র মায়ের ভূমিকায়। তাই মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে তার মা অতি মূল্যবান হয়ে থাকেন। শুধু মানুষ কেনো? পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণিই তার মায়ের কাছে ঋণী। এসব বিষয় আনোয়ারুজ্জামান তাঁর সন্তানদের কাছে তুলে ধরেন।

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ইসলাম মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। তাঁর মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার শোকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শোকরিয়া আদায় করো।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৪) আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২১)

তিনি বলেন, ইসলামে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা প্রথম বড় অপরাধ; আর মাকে কষ্ট দেওয়া ও মায়ের অবাধ্য হওয়া দ্বিতীয় বড় অপরাধ। আল্লাহতায়ালা নিজের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন মাতাপিতার অধিকারের কথা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মায়ের অবাধ্য হওয়াকে তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৫৮০)

নগরবাসীকে ঘিরে মায়ের ভালোবাসা:

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘২০২৩ সালের জুন মাসে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে এসেছেন মা। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্œ হয়ে উঠে। প্রতিদিনই দোয়া পেতাম মায়ের। ২১ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন সকালে আমার জন্যে প্রাণ ভরে দোয়া করেন মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, কপালে চুমু দেন। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্যে বলেন, ভোট দিতে বলেন। মায়ের দোয়া নিয়ে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছি এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে। ভোট গ্রহণ শেষে বাসায় ফিরি। নির্বাচনের ফলাফল আসতে শুরু করে। ফলাফলে উল্লাস প্রকাশ করছিলেন দলীয় নেতাকর্মীসহ পরিবারের সদস্যরা। চূড়ান্ত ফলাফলে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হই। এই খবরে মা উজ্জিবিত হয়ে উঠেন। নগরবাসীর প্রতি কৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাৎক্ষণিক নগরবাসীর সেবা করে ঋণ পরিশোধ করার নির্দেশনা দেন মা। মাসখানিক পর মা ফিরে যান যুক্তরাজ্যে। বিদায় বেলায় মা বলে গেছেন নিজের দিকে খেয়াল রাখার জন্যে। খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করার জন্যে। নগরবাসীকে যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছি তা বাস্তবায়ন করার জন্যে।’