ইতিহাসের কালিমালিপ্ত ঘটনার উৎস সন্ধান এককালে বা একযুগে কখনও শেষ হওয়ার নয়। ঘটনার রহস্যময়তা এবং উৎসের নানামুখি শিকড় হাতড়ালে নতুন নতুন উৎসের উন্মোচন ঘটাই স্বাভাবিক। এবং তারই আলোকে ঘটনার বাস্তবতা নতুন আঙ্গিকে ডানা মেললেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও পটপরিবর্তনের নেপথ্যে যেসমস্ত কার্যকারণ ও উৎস নিহিত ছিল তার সবকটি যে উন্মোচিত হয়েছে তা মনে করার কোনো অবকাশ নেই। বহুমুখি লক্ষ্য এবং নানাবিধ উৎসের সমন্বয় হচ্ছে ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত পটপরিবর্তন। এই উৎস সমূহের কিছু আবিস্কৃত হয়েছে, আর কিছু ছাইচাপা রাখা হচ্ছে কৌশলে। বক্ষমান নিবন্ধে দুটি অনাবিষ্কৃত উৎস সম্পর্কে আলোকপাত করছি।
প্রাসঙ্গিক যে, ১৯৭১ সনটি যেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল স্মারক তেমনি এবছরই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বীজ অলক্ষ্যে বপন হয়েছিল। পরবর্তীতে যা অঙ্কুরিত হয়ে বিষবৃক্ষের আকার ধারণ করত : জাতীয় ট্র্যাজিডিকে টেনে এনেছিল। ধারণাটি স্বচ্ছ করতে কিছু ব্যাখার প্রয়োজন মনে করছি।
৭১ সনের ২৫ ই মার্চের কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার পর যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সে প্রতিরোধ ধারালো হলেও প্রতিপক্ষের মতো সমন্বিত ছিল না। যে যার অবস্থান থেকে বিক্ষিপ্তভাবে লড়াই করে যাচ্ছিল। লড়াইয়ের অগ্র সৈনিক ছিল ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, এবং সদ্য প্রশিক্ষিত ছাত্রসমাজ। স্থানে স্থানে লড়াই হচ্ছিল বিক্ষিপ্তভাবে। তাই এই বিক্ষিপ্ত যুদ্ধকে নেতৃত্বের অধীনে এনে সমন্বিত করার জন্য হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়াতে যে সামরিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার গুরুত্ব ইতিহাসের স্বর্ণ অধ্যায়ে খচিত হবার কথা।
রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের যোগাযোগের মাধ্যমে কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৪ এপ্রিল, তেলিয়াপাড়ার চা-বাগানের বাংলোতে। মেজর পর্যায়ের বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ মেজর এ সম্মেলনে হাজির ছিলেন। মেজর জিয়া সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসেছিলেন একদিন আগেই, বিশেষ উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে। এখানে এসে বেশ কয়েকজন সেনা অফিসারের সাথে যোগাযোগও করেছিলেন। বলা বাহুল্য বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিট সমূহের মধ্যে মেজর জিয়া ছিলেন সিনিয়র। এ ছাড়া তার বাড়তি একটি যোগ্যতা ছিল যে, কালুরঘাট বেতারের কেন্দ্র থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। তাই সঙ্গত ভাবেই তার ইচ্ছা ছিল–তার কমান্ডেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল বিপরীতে। কনফারেন্সে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের বি এস এফ অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার পান্ডে কর্নেল (অব) ওসমানীকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদের নবনির্বাচিত এমএনএ ও ছিলেন কর্নেল ওসমানী। তিনি আগেভাগেই কসবা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, পূর্ব বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার সামরিক নেতৃত্ব প্রদান করবেন ওসমানী এমন ধারণা আওয়ামী লীগের তরফে পূর্বাহ্নেই ভারতকে জানানো হয়েছিল। আইসিএস ডিগ্রিধারী এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ওসমানী বৃটিশ আমলেই লে. কর্নেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এ কারণে ভারতও ওসমানীকে যোগ্য সেনানায়ক বলে গণ্য করেছিল। কনফারেন্স আলোচনায় যুদ্ধে কে নেতৃত্ব দেবেন এ প্রসঙ্গ উঠলে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ওসমানীকে যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে মতামত দিয়েছিলেন। মেজর সফি উল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সাফায়াত জামিল, মেজর নুরুজ্জামান, এবং সি.আর দত্ত প্রমুখরা ওসমানীকেই সেনাধিনায়ক হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে মৌনব্রত পালন করেছিলেন উপস্থিত অন্যান্যরা। এ কনফারেন্সে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এসএম রেজাও উপস্থিত ছিলেন।
অবসরে আসার পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারদের পেনশনের বিষয়টি দেখভাল করতেন। ওসমানীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল সাপেনেউলে। তিনি জিয়াকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সামরিক নেতৃত্বের ব্যাপারে। ওসমানী একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত এম এনএ র প্রসঙ্গ টেনে সামরিক বাহিনীর নিয়মিত অফিসার থেকে অধিনায়ক নিয়োগের প্রসঙ্গটিও এসেছিল। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে সেটিকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ যুদ্ধের প্রকৃতি হবে জনযুদ্ধ, সামরিক নয়। জনযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তার পর বিষয়টি আর আগায়নি৷ ওসমানী হলেন সেনাধিনায়ক। কিন্তু বিভক্তির বীজ যে আড়ালে রোপিত হলো সেটি তখন তেমন গুরুত্ব পায় নি। তবে ঝানু সেনাপতি ওসমানী বিষয়টি আঁচ করতে পারলেও চেপে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোলকাতার থ্রিয়েটার রোডে আহূত সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনে বিভক্তিটি প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠেছিল। সেনাধিনায়ক পরিবর্তনের গুঞ্জন প্রসারিত হলে ওসমানী পদত্যাগ পত্র পেশ করে ১০ই জুলাই তারিখের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব থেকে বিরত থাকেন। এ মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমদ। অবশেষে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের চাপাচাপিতে ওসমানী পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে পরবর্তী মিটিং সমূহে সভাপতিত্ব করেন। এ কনফারেন্সে ৫টির পরবর্তী ১১টি সেক্টর প্রসারিত হলেও জিয়ার সেক্টর কমান্ডার পদটি উড়ে যায়। তাকে আর পদে বহাল রাখেননি ওসমানী। সেই থেকেই জিয়া-ওসমানী বিরোধ লাইমলেইটে চলে এসেছিল। এ বিরোধ তুঙ্গে উঠে পরবর্তীকালে।
৭২ সনের এপ্রিল মাসে ওসমানী যখন সেনাধিনায়ক পদ থেকে সরে যান তখন পরবর্তী সেনাধিনায়ক কে হবেন এ প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। নিয়ম মানলে এবং সিনিয়র বিবেচনায় জিয়াউর রহমান সেনাধিনায়ক হবার কথা। বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে বিদায়ী সেনাধিনায়ক ওসমানীর মতামত জানতে চাইলে তিনি জিয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি এনেছিলেন। বলেছিলেন, জিয়া চরম উচ্চাভিলাসী, জেদি, এবং বিদেশি একটি সংস্থার সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত৷ অগত্যা ওসমানীর পরামর্শ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু কর্নেল সফিউল্লাহকেই সেনাধিনায়ক পদে মনোনীত করেন। জিয়া বিষয়টিকে সহজ দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে নিতে পারেন নি। তখন থেকেই জিয়া বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। ৭৫ সনে দ্বিতীয় দফায় যখন সফিউলল্লাহকে পুঃন নিয়োগ দেওয়া হয় তখন জিয়া অধৈর্য হয়ে পদত্যাগ পত্র পেশ করেছিলেন। অবশ্য তার আগ থেকেই জিয়া নির্ধারিলেত অনুসারে পথ আগাছছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পদত্যাগ পত্রটি গৃহীত করেছিলেন। কিন্তু পদত্যাগ কার্যকর হবার আগেই ১৫ আগস্ট ট্র্যাজিডি ঘটে যায়। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজিডির মূল হোতা যে জিয়া ছিলেন সেটি বেরিয়ে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম আসামি তাহের উদ্দীন ঠাকুরের জবানবন্দিতে৷ ঠাকুর বলেছিলেন—ঘটনার এক সপ্তাহ আগে খন্দকার মুশতাক তাকে ডেকে নিয়ে জানান-সরকার পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তিত অবস্থায় ঠাকুর যাতে খন্দকার মুশতাকের সাথে থাকেন এ অনুরোধও করেছিলেন মুশতাক। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন—ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান তাকে চাপাচাপি করছে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য। জিয়া নাকি সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করছেন। কথা এবং কাজেতো মিলই ছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে ‘দুই নাগিনীর' প্রভাব যে ছিল সেটিও একসময় স্বচ্ছ হয়ে ওঠবে।কথায় আছে—রাজা করে রাজ্য শাসন, রাজাকে শাসায় রাণী। সমাজে অনেকক্ষেত্রে স্ত্রীর প্রভাব স্বামীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজিডির অগ্রনায়ক কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশিদের স্ত্রীদ্বয়ের ভূমিকাও প্রণিধানযোগ্য। ৭৫ সনের ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে যখন মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠিত হয় তখন সে অনুষ্ঠানে কর্নেল রশিদের স্ত্রী জুবাইদা রশিদের হাস্যোজ্জল উপস্থিতি সবার নজর কেড়েছিল। কর্নেল রশিদ তার স্ত্রীকে সবার সাথে পরিচিত করে দিয়ে বলেছিলেন-এই এচিভমেন্টের পেছনে জুবাইদারও অবদান আছে। জুবাইদার অপর বোন কর্নেল ফারুকের স্ত্রী নাজমা রহমানের অবদান কী কম ছিল? অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার জন্য দোয়া চাইতে নাজমা রহমান ১৪ আগস্টে ছুটে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ভণ্ড পীর অন্ধ হাফিজের নিকট। প্রশ্ন উঠতে পারে তার নেপথ্যে কারণ কী? উত্তরে বলা যায়—সহজাত বৈরীপনা। জুবাইদা এবং নাজমা চট্টগ্রামের এ.কে খানের পরিবারভুক্ত। পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের মধ্যে অন্যতম ছিল এ.কে খান পরিবার। মুসলিম লীগের সাথে পরিবারের ছিল নাড়ির বন্ধন। দেশ স্বাধীন হবার পর এই পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তিতে যেমনি ভাটা ধরেছিল তেমনি রাজনৈতিকভাবেও পরিবারটি হয়েছিল নিষ্প্রভ। শুধু এই পরিবার নয় দেশের অন্যান্য প্রভাবশালী পরিবারেও একই অবস্থা ছিল। তাই জুবাইদা ও নাজমা মানসে শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতাও ছিল বিষফোঁড়ার তুল্য। তাদের মানসের পুঞ্জীভূত বিষ ক্রমান্বয়ে প্রয়োগ করে স্বামীদেরকেও বিগড়ে দিয়েছিল তারা৷ তাই দুই প্রভাবশালী সেনা অফিসার সরকার উৎখাতের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেছিল মানসিক প্ররোচনায়। দুই মহিলার এই ‘কৃতিত্বকে’ অস্বীকার করার কোনো পথ আছে? সব শেষে বলা যায় জিয়া এবং ওসমানীর বিরোধের সূত্র ধরে ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা হলেও সরকার উৎখাতের ব্যাপারে দুইজন কী এক মোহনায় ছিলেন, নাকি আলাদা ছিলেন এ প্রশ্নের উত্তরও একদিন মিলবে। তবে বিরোধের খেলায় জিয়ার নিকট ওসমানী হেরে গিয়েছিলেন। ৭৫ সনের সাত নভেম্বরের ফাইনাল খেলায় খন্দকার মুশতাকের পতন যখন অবধারিত হয়ে ওঠে তখন মন্ত্রী পদমর্যাদায় ওসমানী খন্দকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা। বঙ্গভবন থেকে বিদায় লগ্নে খন্দকার মুশতাককে ওসমানী বলেছিলেন— Sorry Old Man. let us Forget and Forgive Everything. We Have Played A Wrong Game. এ কথাটির শানে নুযুল কোথায় যে দাঁড়ায় তা বলা মুশকিল