ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অভাবের কারণে স্কুলত্যাগ, ৬১ বছর পর বকেয়া বেতন পরিশোধ

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ৯ জুন ২০২৩ ০৬:৪২:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়
 
 
১৯৬২ সালে বয়স যখন ১৯, তরুণ এই বয়সেই বিয়ে করেছিলেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মহম্মদপুর গ্রামের বৃদ্ধ সোহরাব হোসেন বিশ্বাস। ইচ্ছে ছিল বিয়ের পরও পড়াশোনা করার। তবে সেই সময়ে বাড়ির কাছে কোনো হাইস্কুল ছিল না। পরে ৫ থেকে ৬ মাইল দূরের ফুলহরি হাইস্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন ষষ্ঠ শ্রেণির মাসিক বেতন ছিল ৪ টাকা।
 
পরবর্তীকালে এই বিদ্যালয়েই ৬ মাস পড়াশোনাও করেন সোহরাব হোসেন। তবে অর্থাভাবে চার মাসের বেতন বকেয়া হয়ে পড়ে। যার ফলে পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে পড়াশোনা ছেড়ে শুরু করেন তামাক-সুপারির ব্যবসা।
 
বর্তমানে সোহরাব হোসেনের বয়স ৮০ বছর। জীবন সায়াহ্নে এসে তার ইচ্ছা হয়- মৃত্যুর আগে সব ধারদেনা পরিশোধ করবেন। সে অনুযায়ী সবার বকেয়াও পরিশোধ করেছেন। একপর্যায়ে মনে পড়ে- ছেলেবেলার ফুলহরি হাইস্কুলে তার চার মাসের বেতন বকেয়া ছিল। ফলে বৃহস্পতিবার (৮ জুন) ছেলেবেলায় পড়াশোনা করা বিদ্যালয়ে সশরীরে হাজির হন বৃদ্ধ সোহরাব হোসেন। রশিদ কেটে জমা দেন ৬১ বছর আগের বকেয়া বেতন।
 
দীর্ঘ পাঁচ যুগ পর বিদ্যালয়ের মাসিক বেতনের বকেয়া টাকা পরিশোধ করে সোহরাব হোসেনের এমন নৈতিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছে পুরো জেলাজুড়ে।
 
স্থানীয় ছাত্র আশিকুর রহমান বলেন, তিনি যা করেছেন, তা অনন্য দৃষ্টান্ত। এমন ঘটনা নবীন-প্রবীণদের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় ঘটনা। আমার জীবনে দেখা সেরা একটি ভালো খবর এটি।
 
একই অনুভূতি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা সম্রাট হোসেন। তিনি বলেন, কিছু খবর শুনলে অনেক ভালো লাগে। এই খবরটি তার মতোই একটি। বৃদ্ধ বয়সে তিনি যা করে দেখালেন- তা অবিশ্বাস্য ঘটনা। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এটি সারাজীবন তাদের পাথেয় হয়ে থাকবে।
 
সোহরাব বিশ্বাস জানান, পড়াশোনা ছাড়ার পর যশোরে গিয়ে পুলিশ সদস্য হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু সেখান থেকেও চলে আসেন দুই মাস পর। এর পর থেকে মহম্মদপুর গ্রামে কৃষি কাজ করতেন বাবার সঙ্গে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চলে যান ভারতের নদীয়া জেলার বেতাই যুব ক্যাম্প এলাকায়। তাঁর দাবি, পুলিশের প্রশিক্ষণ থাকায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেতাই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হয়ে যান। স্বাধীনতার পর চলে আসেন দেশে। এর পর থেকে কৃষি কাজ করেই সংসার চালাতেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তবে সন্তানদের কেউ সঙ্গে না থাকায় সেনাবাহিনীতে চাকরি করা এক নাতিকে নিয়েই তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিনা বেগম থাকেন। বর্তমানে সোহরাব আলী নিজের ও স্ত্রীর বয়ষ্ক ভাতা আর নাতির দেওয়া আর্থিক সহযোগিতায় সংসার চালাচ্ছেন।
 
সোহরাব আলী বলেন, ‘মাঝে মাঝে ভাবি আর কত দিনই বাঁচব! বেতন বকেয়া রেখে মারা গেলে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। কিন্তু চেষ্টা করেও পারতাম না পরিশোধ করতে। অবশেষে নিজেদের ভাতার টাকা ও নাতির দেওয়া টাকা জমিয়ে রসিদ কেটে বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছি। বর্তমান বাজার মূল্যে বকেয়া বেতনের টাকা হয়তো বেশি হবে। তবুও বেতন শোধ করে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। এখন আমার খুবই ভালো লাগছে। আল্লাহর কাছেও বলতে পারব আমি বকেয়া রাখিনি।’ তবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তাঁর নাম না ওঠায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। 
 
সোহরাব হোসেনের ছেলেবেলায় পড়াশোনা করা ফুলহরি হাইস্কুলের বর্তমান অফিস সহকারী হাদিকুর রহমান। তিনি জানান, সোহরাব হোসেনের কথায় আমরা সবাই বিস্মিত হয়ে যাই। পরে তার ইচ্ছামতো ৩০০ টাকা জমা নিয়েছি।
 
বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক লক্ষ্মণ প্রসাদ সাহা বলেন, দুপুরের দিকে একজন বয়স্ক ব্যক্তি স্কুলে উপস্থিত হয়ে নিজেকে প্রাক্তন ছাত্র বলে পরিচয় দেন। তারপর তার অভিপ্রায়ের কথা বলেন। ৮০ বছর বয়সী সোহরাব হোসেনের কাছে তৎকালীন বকেয়া বেতন হিসেবে বিদ্যালয়ের পাওনা ছিল ২৪ টাকা। ৬১ বছর পর তিনি পরিশোধ করেন ৩০০ টাকা। অফিস রুমে এসে রশিদ কেটে এই টাকা জমা দেন তিনি।
 
শৈলকুপার ইউএনও রাজিয়া আক্তার চৌধুরী জানান, সোহরাব আলীর বেতন পরিশোধের বিষয়টি খুবই ভালো লাগার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি তাঁর কাছে থাকা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমাদের দিলে যাচাই-বাছাই করে সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।