উপকূলে বিকল্প জ¦ালানী হিসাবে পরিবেশ বান্ধব ব্যয় সাশ্রয়ী জ¦ালানী গুলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলে সাধারণত চিংড়ী চাষের আধিক্য থাকায় বৃক্ষ রাজি কম একই সাথে ধান চাষের উৎপাদন কম থাকায় বিচালী,নাড়া বা খড় কম। ফলে জ¦ালানী সংকট রয়েছে সব সময়। এই জ¦ালানী সংকটের ফলে বিকল্প জ¦ালানী হিসাবে গ্রামীণ নারীরা গুলের ব্যবহার করছে প্রায়ই ঘরে ঘরে।
গুল হল এক ধরনের জ¦ালানী। গুল তৈরীর প্রধান উপকরণ হলো কয়লা ও কাদামাটি। জ¦ালানী হিসাবে কাঠ ব্যবহারের পর অবশিষ্ট ছাই থেকে কয়লা তৈরী করা হয়। কয়লা ভালভাবে গুড়া করে তার সাথে নরম কাদা মাটি মিশিয়ে গোল পাকিয়ে রোদে শুকিয়ে এই গুল তৈরী করা হয়। কয়লার গুড়া একবারে মিহি হবে না কিছুটা তেতুল বিচির মত হবে এবং নরম কাদা পুকুর বা জলাশয়ের পঁচা কাদা মাটি হলে ভাল হয়।
পরিমান হিসাবে বুড়িগোয়ালিনী ইউপির গৃহিনী ছায়া রানী বলেন প্রায় এক কেজি কয়লার সাথে প্রায় ২৫০ গ্রাম কাদামাটি মিশিয়ে গুল তৈরী করা হয়। নকিপুর গ্রামের বাসিন্দা গৃহিনী শর্মিষ্ঠা রানী বলেন এক ঝুড়ি কয়লায় অর্ধ ঝুড়ি কালো নরম মাটি লাগে। এটি সাধারণ কয়লা ও নরমমাটি মিশিয়ে ৩/৪ দিন কড়া রৌদে শুকিয়ে জ¦ালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এটি তৈরী করে সংরক্ষণ করে রাখা যায় বহুদিন।
বুড়িগোয়ালিনী ইউপির আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা কৌশল্য মুন্ডা বলেন জ¦ালানী হিসাবে গুল ব্যবহারের সুবিধা অনেক। সুবিধা হিসাবে বলেন এই জ¦ালানীর উৎপাদন খরচ খুব কম। একই জ¦ালানী থেকে দুয়ের ব্যবহার। প্রথমে কাঠ দিয়ে রান্না করে পরে কাঠ থেকে কয়লা বের হলে সেটা দিয়ে গুল তৈরী করে আবারও জ¦ালানী হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবারের গৃহিনীদের সাময়িক পরিশ্রম করলে জ¦ালানী তৈরী করা সম্ভব বলে জানান। ধূমঘাট গ্রামের বাসিন্দা বিনোদিনী মুন্ডা বলেন গুল তৈরীতে খরচ নাই। কাঠ জ¦ালানোর পর কাঠে সামান্য জল দিলে আগুন নিভানো হলে কয়লা তৈরী হয়ে যায়। আর কয়লার সাথে নরম পঁচা কাদা মাটি মিশিয়ে দিয়ে গোল গোল করে পাকিয়ে গুল তৈরী করা হয়। এর পর এর আর একটা সুবিধা বলেন গুল জ¦ালানোর পর ছাই হয়ে গেলে সেই ছাই দিয়ে হাড়ি, কড়া, থালা বাসন পরিস্কার করা যায়।
জ¦ালানী হিসাবে গুলের ব্যবহারের ফলে কাঠের উপর চাপ কম পড়ছে বলে উল্লেখ করেন বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার। তিনি বলেন উপকূলের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় চিংড়ী চাষ শুরু হয় প্রায় আশির দশক থেকে। আর এই সময়ে জ¦ালানী সংকট শুরু হতে থাকে। সেময়ে বুড়িগোয়ালিনী, দাতিনাখালী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, ভেটখালী সহ অন্যান্য স্থানে গুলের ব্যবহার কম বেশি হতে থাকে। তবে সঠিক জানা যায়নি গুলের ব্যবহার কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে বা কিভাবে আবিস্কার হল। তিনি বলেন আইলার পর থেকে উপকূলে গুলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বারোমাস জ¦ালানী হিসাবে ব্যবহার করা যায়। তিনি বলেন উপকূলীয় জনপদে এক বিশেষ জ¦ালানী গুল।
নকশীকাঁথা মহিলা সংগঠনের পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জী বলেন শ্যামনগর উপজেলায় রান্নার কাজে জ¦ালানী সংকট রয়েছে। জ¦ালানী সংকট সমাধানে শুকনা মৌসুমে দেখা যায় গ্রামীন নারীদের পাতা কুড়ানো, লাকড়ি কুড়ানো, জমি থেকে ধানের অবশিষ্ট অংশ সংগ্রহ, কাগজ কুড়ানো ইত্যাদি। গ্রামীন নারীদের জ¦ালানী সংকট সমাধানে এখন শহর কেন্দ্রিক বা গ্রাম গঞ্জেও সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তবে তিনি বলেন পরিবারের আর্থিক অবস্থায় বিবেচনা করে গ্রাম গঞ্জে বিকল্প জ¦ালনাী গুলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এটি পরিবেশ বান্ধব ব্যয় সাশ্রয়ী জ¦ালানী।
দাতিনাখালী গ্রামের বনজীবি নারী সংগঠনের পরিচালক শেফালী খাতুন বলেন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে গ্রামীণ নারীরা রান্নার কাজে গুলের ব্যবহার করছেন। গুল ব্যবহারের ফলে গাছের উপর কিছুটা হলেও চাপ কম পড়বে এর ফলে পরিবেশ বাঁচবে। গুল ব্যবহারের আরএকটা সুবিধা তিনি উল্লেখ করেন সেটি হল হাড়ি পাতিলে কালি পড়ে না। ঘরের মধ্যে ধোঁয়া সৃষ্টি কম হয়। তিনি পরিবেশ বান্ধব জ¦ালানী গুলের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সকলকে আহব্বান জানান। গ্রামীন নারীদের এটি একটি লোকায়াত জ্ঞান ও র্চ্চা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্থানীয় পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা গুলের ব্যবহার পরিবারে আর্থিক সাশ্রয় হবে বলে উল্লেখ করেন। এটি একটি জৈব জ¦ালানী পরিবেশ বান্ধব জ¦ালানী হিসাবে উল্লেখ করে এর ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য আহব্বান জানান।