১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর সাথে প্রচন্ড সম্মুখ যুদ্ধের পর ৭নং সেক্টরের আওতায় দিনাজপুরের হিলি শত্রæ মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে উপজেলার বোয়ালদাড় গ্রামের মোস্তফা, একরাম উদ্দিন, বানিয়াল গ্রামের মুজিব উদ্দিন শেখ, ইসমাইলপুর গ্রামের মনিরউদ্দিন, মমতাজ উদ্দিন, বৈগ্রামের ইয়াদ আলী ও চেংগ্রামের ওয়াসিম উদ্দিন শহীদ হন। এছাড়া গুলিবিদ্ধ জন দক্ষিণ বাসুদেবপুরের ছহির উদ্দিন ও মুহাড়া পাড়ার মহাতাব উদ্দিন। হিলির মুহাড়া পাড়া এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ “সম্মুখ সমর”।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ক্যাপ্টেন আনোয়ারের সিদ্ধান্তে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের হিলির ডা. মনিন্দ্রনাথের বাসায় প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয় এবং এসকল মুক্তিযোদ্ধাদের বালুরঘাট ট্রানজিট ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত করে পতিরামে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। এসময় ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও তার দলের কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং প্রদান করে। বালুরঘাট ট্রানজিট ক্যাম্পটি তৎকালিন এমপি এবং এমসি এর তত্বাবধানে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বালুরঘাটের কুমারপাড়ার কুড়মাইল ক্যাম্পে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বানিজ্য মন্ত্রী আব্দুল জলিল, অধ্যাপক আবু সাইদ (সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী) এর নেতৃত্বে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সেচ্ছাসেবক দল মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করা হয়। ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ভাবে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করে।
৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন দানের পর হিলিতে ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর সাথে পাক সেনাদের প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম দিকে হিলির মুহাড়া পাড়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সহ মিত্র বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। এসময় তরুন মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা শহীদ হন। পরবর্তীতে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা সু-সংঘঠিত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মুহাড়া পাড়া এলাকাসহ পাক সেনাদের বিভিন্ন আস্তানায় আকাশ পথে এবং স্থল পথে একসঙ্গে হামলা চালায়। দুইদিন যাবৎ প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী পরাস্ত হলে ১১ ডিসেম্বর বেলা ১টার দিকে মুক্তিযুদ্ধের ৭ সেক্টরের আওতায় হিলি শত্রæ মুক্ত হয়।
এদিকে দিবসটি উদযাপনে বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহণ করেছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ, হাকিমপুর পৌরসভা ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড। এ উপলক্ষে ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় হিলি সীমান্তের চেকপোস্ট সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয় থেকে এক বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে। হিলি স্থলবন্দরের শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে স্থানিয় বাসুদেবপুর বিজিবি ক্যাম্পের পাশে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ “সম্মুখ সমরে” গিয়ে শেষ হবে শোভাযাত্রাটি। এসময় সেখানে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এসময় শাহাদতবরণকারী শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা করা হবে। পরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এরপর সেখানে বেলা ১১টায় আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ডের সভাপতি সাংবাদিক জাহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লিয়াকত আলীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লিয়াকত আলী জানান, রণকৌশলগত কারণে হিলি দখলে নিতে এপ্রিল মাস থেকে আকাশ ও সড়ক পথে থেমে থেমে হামলা চালায় হিলি সীমান্তবাসীর ওপর পাকসেনারা। একপর্যায়ে ৯ ও ১০ ডিসেম্বর মুহাড়াপাড়া গ্রামের পাশে মিত্রবাহিনীর সাথে প্রচন্ড সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদত করেন ৩৪৫ জন মিত্রবাহিনী সহ মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয়েছিলেন প্রায় দুই হাজারের মত। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর মুক্ত হয় হিলি। দিনটি স্মরনীয় করে রাখতে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়েছে।