মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া বসবাস করতে পারে না। সমাজে বসবাস করতে গেলেই সমাজের কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয়। আর যখন এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঠিক তখনই প্রয়োজন হয় বিভিন্ন মহলের হস্তক্ষেপ। তাই সাহিত্য যুগে যুগে সমাজের নানাবিধ বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে সমাজ বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই সমাজ উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে কবি সাহিত্যিকদের ভাবনা অনস্বীকার্য। সে হিসেবে বলতে হয়, কবিতা সুষ্ঠু ধারার সমাজ গঠনের চালিকা শক্তি হিসেবে যথাযথ অবদান রাখছে।
কালের গতিময়তার মাধ্যেমেও অদৃশ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ পৃথিবীতে সবই গতির অধীন। তাই সবই ক্রমশ: অনন্তহীন গতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই সময় থাকতেই আমাদেরকে সমাজ তথা মানুষের জন্য কিছু করার জন্য বলেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত বলাকা কাব্যগ্রন্থের বলাকা কবিতায় উল্লেখ করেছেন- মনে হল এ পাখার বাণী/দিল আনি/শুধু পলকের তরে/পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে/বেগের আবেগ। কবি এখানে গতিময়তার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি একই কাব্যগ্রন্থের ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা নামক কবিতায় উল্লেখ করেছেন- ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। কবি এ অংশটুকুর মাধ্যমে সমাজের অবহেলিতদের বাঁচাতে বিশেষ করে তরুণ যুবকদের প্রতি আহ্বান করেছেন।
সমাজ জীবনে মানুষের অশেষ দুঃখ-দুর্দশা রয়েছে। মানুষের অনন্তহীন দুঃখ দুর্দশা বা বেদনার ডাক শুনে মহারাজাও রাজ্য ছেড়ে হৃদয় নামক ধ্যান-গুহায় বসে ভাবেন। সে জন্য আমাদের প্রত্যেককেও সমাজের জন্য ভাবতে হবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কবিতায় উল্লেখ করেছেন- এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি/ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি। প্রেমের কবি ও দ্রোহের কবি তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় উল্লেখ করেছেন- মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য। কবি সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনে তিনি একজন প্রেমিক আবার একজন বীর যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছেন। আবার একই কবিতায় উল্লেখ করেছেন- মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেই-শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। কবি এ অংশে যে পর্যন্ত উৎপীড়িত মানুষের কান্নার শব্দ থাকবে সে পর্যন্ত তিনি এর বিদ্রোহে যুদ্ধ করেই যাবেন। এর আগে তিনি থামবেন না বলেছেন।
সমাজের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুঃখকালীন সময় থেকে বাঁচার জন্য আশার আলো সম ভোরের ছোঁয়া প্রত্যাশা করছেন। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার জীবনমুখী রানার কবিতায় উল্লেখ করেছেন- রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে আকাশ হয়েছে লাল/আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?
তিনি তার আরেক বিখ্যাত কবিতা হে মহাজীবন কবিতায় উল্লেখ করেছেন- ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ/পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। এখানে কবি ক্ষুধাময় এ রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করেছেন। ক্ষুধার্ত মানুষের খাবারের আকাঙ্খার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। এ থেকে পরিত্রাণে সামাজিক রীতি-নীতি বা দৃষ্টি-ভঙ্গির পরিবর্তন দরকার বলে তিনি মনে করেন।
মানুষ মরণশীল। নশ্বর এ পৃথিবীতে কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না। তাই কবি যতক্ষণ বেঁচে থাকবেন ততক্ষণ তিনি নবজাতক বা সদ্য ভুমিষ্ঠ শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি তার আরেক বিখ্যাত কবিতা ছাড়পত্র কবিতায় উল্লেখ করেছেন- চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
সমাজের চাষী বা কৃষক সমাজ তাদের নিজেদের সুখকে বিসর্জন দিয়ে পরোপকারে সর্বদা নিয়োজিত আছেন। তাই কবি তাদেরকে বার বার নমস্কার জানিয়েছেন। সেই সাথে তাদেরকে দেখে যেন সমাজের অহংকারী লোকদের গর্ব চূর্ণ হয়ে যায়। এ বিষয়েই বার্তা দিয়েছেন তিনি। তাই কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী তার চাষী কবিতায় উল্লেখ করেছেন- ব্রত তাহার পরের হিত/সুখ নাহি চায় নিজে/রৌদ্র দাহে শুকায় তনু/মেঘের জলে ভিজে। আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার/তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া বাস করতে পারে না। সমাজে বাস করতে গেলে একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল। তাই কবি কামিনী রায় তার পরার্থে কবিতায় এ কথাই উল্লেখ করেছেন- আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুম কুমারী দাশ তার আদর্শ ছেলে কবিতায় উল্লেখ করেছেন- আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে/মুখে হাসি বুকে বল,তেজে ভরা মন/‘মানুষ হইতে হবে’ এই যার পণ। কবি এখানে আমাদের সমাজের সেই সব ছেলেদের কথাই বলেছেন। যারা কথায় কথায় বড়লোকি বা আস্ফালন কথা-বার্তা না বলে মানুষের মত মানুষ হওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে সমাজের কাজে আসবে।
তরুণ কবি প্রদীপ চন্দ্র মম (কাব্যতীর্থ) তার আলো ছায়ার গহীন তলে নামক কাব্যগ্রন্থের অধীন অলীক আশ্বাস কবিতায় উল্লেখ করেছেন- তোমরা শুনো/ দরিদ্র, অশিক্ষিত চাষা জনগণ,/ আমি উদ্ভট বাংলাদেশের হীরক রাজা বলছি-/ শুধু তোমাদের সুখের জন্য আমি ভীষণ কষ্টে আছি।/ রাতদিন দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে বড্ড ক্লান্ত;/ কষ্টের কথা শোনার সময় নেই আমার,/ কবি এ অংশটুকুর মাধ্যমে দেশের দরিদ ও অশিক্ষিত চাষা জনগণকে পুজি করে তাদেরকে অবাস্তব আশ্বাস দিয়ে নিজের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে বড় ব্যস্ততার বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। অপরদিকে তিনি একই কবিতার শেষের দিকে উল্লেখ করেছেন- তোমরা শোন,/ আমি উদ্ভট বাংলাদেশের হীরক রাজা বলছি-/ বিরোধী দল আর দেশদ্রোহীদের কথায় কান দিওনা;/ নির্বাচনী খরচের টাকা হয়ে গেলেই, যা পাবো/ জনগণকে সুষম সমবন্টনে বন্টন করে দিবো। না হয়/ তোমার অধিকার আদায়ে রাজপথে নিজেকে কুরবান করে দিবো। কবি এখানে চাটুকার ও মিথ্যাবাদী অযোগ্য নেতাদের আগে নিজের পকেট ভারী করে পরে জনগণের সুযোগ সুবিধার চাতুর্যপূর্ণ উপদেশ ও অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দেয়ার বিষয়টিই ফুটিয়ে তুলেছেন। সমাজের এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে শিক্ষিত ও সচেতন মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি একই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত নেতার আশ্বাস নামক কবিতায় উল্লেখ করেছেন- নেতা-/আনারসের মতো তেলতেলা, হারিকেন হাতে/ জনসেবাই লক্ষ; উন্নয়ন সে-কি আর বলতে হয়? কবি এ অংশটুকুর মাধ্যমে বর্তমান হাল ফ্যাশনের যুগে নেতাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন মিথ্যা আশ্বাস সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছেন। তিনি যোগ্য নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন তথা বর্তমান ঘুণে ধরা সমাজকে পরিবর্তন করার আশাবাদী। এছাড়া তিনি একই কবিতায় বর্তমান সমাজের নেতাদের মিথ্যা আশ্বাস সম্বলিত বক্তব্য তথা তাদের দাম্ভিকতাপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সমাজের নানা অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের সচেতনতার পাশাপাশি সহযোগিতা কামনা করেছেন। যেমন- বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা, প্রবাসে কর্মী ছাটাই,/ পূর্বনেতার দুর্নীতি- তবে ভয় নেই কোন/ আমার ভয়ংকর কর্মীবাহিনী। আমার টিআর/ আমি দিব, টাকা পেলে যাকে খুশি তাকে দিব।
পরিসংহারে বলা যায়, সমাজ পরিবর্তনে কবিদের ভাবনা তাদের কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
লেখক: সাংবাদিক ও ডিরেক্টর- বাংলাদেশ সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাব, ঢাকা এবং সাবেক শিক্ষক ও এনজিও কর্মকর্তা।