জন্মভূমি নড়াইল জেলার কালিয়া থানার পাখিমারা গ্রামে নিজ বসতভিটায় সময় কাটতে থাকে অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে অভাব। অভাবের তাড়নায় শিশুদের কান্না ভেসে আসে কানে। ওই কান্না শুনে আকুল হয়ে উঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আজিজুর রহমান। কিন্তু করার কিছু নেই।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলোর কথা ওইভাবে দৈনিক বায়ান্নকে জানাচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আজিজুর রহমান।
তিনি জানান, পাক হায়েনারা পাখিমারা গ্রামের সিংহভাগ ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়ার পর গ্রামবাসী প্রায় খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছিলেন। ঘরবাড়ি হারানো লোকজনের মাথা গোজার জন্যে পাটখড়ি আর নারা দিয়ে ঘর বানানো শুরু হলো। ওই ধরণের ঘরে মাথা গোজার ঠাঁই হলো। কিন্তু ক্ষুধার্থ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যুদ্ধের বছর কেউ ফসল ফলায়নি। ফলে গ্রামের প্রতিটি ঘরই খাবার শূণ্য। নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হচ্ছিল। ওই সময় স্থানীয় এমপি ছিলেন এখলাছ উদ্দিন। তিনি বসবাস করেন কালিয়া উপজেলা সদরে। ১৮ মার্চ সরদার আজিজুর রহমান পায়ে হেঁটে কালিয়া উপজেলা সদরে গেলেন এমপি এখলাছ উদ্দিনের সাথে দেখা করার জন্যে। গ্রামের ভয়াবহ অবস্থা জানানোর জন্যে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন এমপি এখলাছ উদ্দিন ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। যুদ্ধের শেষ দিকে হায়েনাদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন তিনি। আবার পায়ে হেঁটে ফিরে আসেন বাড়িতে। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাতে থাকেন।
সরদার আজিজ জানান, অক্টোবর মাসে জানতে পারলেন এমপি এখলাছ উদ্দিন বাড়িতে এসেছেন। খবর পেয়ে ছুটে গেলেন। সরদার আজিজকে দেখে কাছে টেনে নিলেন এমপি এখলাছ উদ্দিন। আগে থেকেই এমপি এখলাছ উদ্দিনের পরিচয় ছিল সরদার আজিজের। এর আগে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল কলকাতার মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে। এমপি এখলাছ উদ্দিনকে পাখিমারা গ্রামবাসীর করুণ অবস্থা জানালেন সরদার আজিজ। এমপি এখলাছ বললেন কিছু রিলিফ এসেছে। ওখান থেকে কাপড় ও বিস্কুট নিয়ে যাও। প্রায় আড়াই’শ মানুষের কাপড় দিলেন। বিস্কুট দিলেন ১০ টিন। এসব বিস্কুট ছিল অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধ। কাপড় ও বিস্কুট আনতে প্রয়োজন নৌকার। কিন্তু নৌকায় গ্রামে পৌঁছতে সময় লাগবে দুইদিন। ওই নৌ পথে আরো কয়েকজন একই ধরণের পণ্য নিয়ে যাওয়ার কথা হলো। যেসব পণ্য দিয়েছিলেন এমপি এখলাছ উদ্দিন। একটি নৌকা ভাড়া করে সবাই নিজ নিজ পণ্য উঠালেন। একে একে সবাই পথিমধ্যে রিলিফ সামগ্রী নিয়ে নেমে যান। সর্বশেষ পাখিমারা গ্রামে রিলিফ সামগ্রী নিয়ে পৌঁছেন সরদার আজিজ। নৌকায় কাটাতে হয়েছে দুইদিন। গ্রামে ফিরে রিলিফ সামগ্রী অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেন সরদার আজিজ। কিন্তু সামান্য ওই রিলিফ দিয়ে কি হয়। তীব্র অভাবের মধ্যে নিরন্ন অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছিল সরদার আজিজকে। সরদার আজিজের পৈত্রিক ব্যবসা ছিল খুলনায়। বিহারীরা তা লুটপাট করে জ¦ালিয়ে দেয়। যুদ্ধের সময় ফসল ফলাতে পারেননি। এই অবস্থায় ঘরে খাবারের কিছুই ছিল না। অনেকদিন কেটেছে কোনো ধরণের খাবার না খেয়েই। বাড়ির বাইরে কাচারি ঘরে পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাতযাপন করতেন সরদার আজিজ।
ডিসেম্বর মাসে জন্ডিস রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ঘরে ঘরে লোকজন আক্রান্ত হতে থাকেন ওই জন্ডিস রোগে। জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কবলে পড়েন অনেকে। মৃত্যুর সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। সরদার আজিজের দুই ভাইও মৃত্যুবরণ করেন ওই জন্ডিস রোগে। এই দুই ভাইয়ের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। এক সময় সরদার আজিজও আক্রান্ত হন জন্ডিস রোগে। জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে দিন দিন দুর্বল হতে থাকেন তিনি। একেত ঘরে খাবার নেই, তার উপর জন্ডিস রোগের থাবা মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে তোলে সরদার আজিজকে। একদিন তিনি খুলনায় গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন জন্ডিস রোগে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে শহরটি। ফিরে আসেন বাড়িতে। নিয়তির উপর ছেড়ে দেন নিজকে।
সরদার আজিজ জানান, ওই সময় সমাজ থেকে মায়া মমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কেউ কারো খবর রাখেন না। বিপর্যয়ের মধ্যে সবাই দিন কাটাচ্ছেন। দরদমাখা হাত বাড়িয়ে দেওয়ারও কেউ ছিল না। নিজ গ্রামে সরদার আজিজের সিনিয়র এক বন্ধু ছিলেন। তাঁর নাম নেহার। তিনি ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। নেহার দাদা যোগাযোগ করলেন সরদার আজিজের সাথে। জানালেন তাঁর কাছে একটি ওষুধ আছে। কিন্তু ওষুধটি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথম ডোজ খাওয়ার পর টিকে গেলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। পরবর্তীতে তিন ঘন্টা অন্তর অন্তর আরো কয়েক ডোজ খেতে হবে। শক্তি হারিয়ে ফেলা সরদার আজিজ অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন ওই ওষুধ খাবেন। নেহার দাদাকে জানিয়ে দিলেন সিদ্ধান্তের কথা। একদিন রাত ১০ টায় নেহার দাদা ওষুধ নিয়ে হাজির হলেন সরদার আজিজের কাচারি ঘরে। সাথে ছিলেন নেহার দাদার মমতাময়ী মা। তিনি আবার সনাতন ধর্মের ধার্মীক মহিলা ছিলেন। সাথে এনেছিলেন দেবতার ছবি। ওষুধ খাওয়ার আয়োজন করা হলো। সরদার আজিজ প্রথম ডোজ ওষুধ খেলেন। নেহারের মা ভগবানকে স্মরণ করতে লাগলেন গীভর ধ্যানের মধ্য দিয়ে। প্রথম ডোজ খাওয়ার পর ধীরে ধীরে তিন ঘন্টা সময় কেটে যায়। নেহার দাদা ও তাঁর মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠে। জানালেন শঙ্কা কেটে গেছে। রাতের মধ্যে আরো দুই ডোজ খাওয়ালেন। নেহার দাদা ও তাঁর মা বসেছিলেন সরদার আজিজের শিয়রের পাশে। সকালের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সরদার আজিজকে ধরে বসালেন নেহারের মা। নেহারের মাকে জানালেন পাতলা জাউ খেতে পারলে, সরদার আজিজের ভালো লাগত। সেদিন নেহারের মা জাউয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। মা ও সন্তানের আন্তরিক সেবায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন সরদার আজিজ।
সরদার আজিজ বলেন, ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে রওয়ানা হলেন ফেঞ্চুগঞ্জের পথে। উদ্দেশ্য এখানে কিছু একটা করে জীবিকা নির্বাহ করবেন। আর এই ফেঞ্চুগঞ্জে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। এই ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে গিয়েছিলেন রণাঙ্গণে। ফেঞ্চুগঞ্জে পৌঁছলেন। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা প্রায় সর্বত্র বিরাজ করছে। এতে তিনি আরো অস্থিতর হয়ে উঠলেন। সরদার আজিজের সাথে পরিচয় ছিল হবিগঞ্জের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক চৌধুরীর। ফেঞ্চুগঞ্জ ছেড়ে রওয়ানা হলেন হবিগঞ্জে। উদার মনের মানুষ ছিলেন মানিক চৌধুরী। সরদার আজিজকে দেখে তিনি অবাক হলেন। কাছে টেনে নিলেন। সরদার আজিজ নাজুক পরিস্থিতির কথা জানালেন। সরদার আজিজের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন এমপি মানিক চৌধুরী। তখন সময় ফেব্রæয়ারি মাস। প্রায় দুই মাস কাটালেন সেখানে। শারীরিকভাবে অনেক সুস্থ হয়ে উঠলেন সরদার আজিজ। বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক চৌধুরীকে বললেন একটি কাজ যুগিয়ে দেয়ার জন্যে। সে সময়কার হবিগঞ্জের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সোনাহর আলীর কাছে সরদার আজিজকে নিয়ে গেলেন মানিক চৌধুরী। সোনাহর আলী চাকরি দিলেন সরদার আজিজকে। সোনাহর আলীর ব্যবসার টাকা রাখার একটি ঘর ছিল। ওই ঘরের একটি সিন্দুকে টাকা রাখা হতো। সরদার আজিজের ডিউটি ছিলো ওই ঘরে রাত যাপন করা। সন্ধ্যার পর সকল ব্যবসা থেকে যেসব টাকা আসত, তার হিসেব খাতায় লিখে রাখা। রাতে সোনাহর আলী আসতেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে সিন্দুকের চাবি সরদার আজিজের কাছে রেখে যেতেন। টাকার সিন্দুক পাহাড়া দিয়ে নির্ঘুম রাত কাটত সরদার আজিজের। সরদার আজিজ ওই দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সোনাহর আলীর সন্তানদের নিয়ে সময় কাটাতেন। নিয়মিত সংবাদপত্র রাখতে ও পড়তেন। এখানে চাকরি পাওয়ার সময় সরদার আজিজের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস কেটে গেলেও কোনো বেতন দেয়া হচ্ছিল না। ওই অবস্থায় সরদার আজিজ মাঝে মধ্যে ম্যানেজারের কাছ থেকে ১০ টাকা বা ২০ টাকা নিতেন। সে সময় ১০ টাকার মূল্য ছিলো অনেক। সরদার আজিজ ওই টাকা দিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্টে খেতেন সোনাহর আলীর সন্তানদের নিয়ে। মাঝে মধ্যে এমপি মানিক চৌধুরীর কাছে যেতেন। মানিক চৌধুরী ১০-২০ টাকা তুলে দিতেন সরদার আজিজের হাতে। ওই টাকা তিনি তাঁর বাবার নামে পাঠিয়ে দিতেন মানি অর্ডারের মাধ্যমে। এভাবে এক বছরের উপর কেটে যায়। একদিন সোনাহর আলী বুঝতে পারলেন রাত জেগে টাকার সিন্দুক পাহাড়া দেন সরদার আজিজ। তিনি ডাকলেন সরদার আজিজকে। বললেন, রাত জেগে টাকা পাহাড়া দেয়ার প্রয়োজন নেই। ডাকাতরা নিয়ে গেলে, তাতে বাধা দেয়ারও প্রয়োজন নেই। তুমি (সরদার আজিজ) যদি সব টাকা নিয়ে যাও, তাতেও আমার বাধা নেই। সোনাহর আলীর ওই কথার পর সরদার আজিজ আর কিছু বলতে পারেননি।
সরদার আজিজ জানান, ৭৪ সালের জুলাই মাসে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় লোক নিয়োগ দেয়ার একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় পত্রিকায়। পত্রিকা নিয়ে সরদার আজিজ ছুটে গেলেন এমপি মানিক চৌধুরীর কাছে। সরদার আজিজ ওই কারখানায় চাকরি পেতে চান বলে জানালেন এমপি মানিক চৌধুরীরে। এমপি মানিক চৌধুরী সব ধরণের সহযোগিতা করার আশ^াস দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সনদ সত্যায়িত করে দিলেন। ফেঞ্চগঞ্জ সারখারখানা কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন পাঠালেন। ডিসেম্বর মাসে ইন্টারভিউ কার্ড হাতে পেলেন। ইন্টারভিউ কার্ড হাতে পেয়ে সাক্ষাত করলেন সোনাহর আলীর সাথে। বিস্তারিত জানালেন। সোনাহর আলী ভাবলেন মিথ্যা বলছেন সরদার আজিজ। কারণ, বেতন দেয়ার কথা বলেও কোনো বেতন দেননি দীর্ঘ সময়ের মধ্যে। সরদার আজিজকে বললেন, মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। তোমার যত টাকা দরকার, তা নিতে পার। মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সরদার আজিজ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। দুইদিন পর সোনাহর আলীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ দেয়া হয় সরদার আজিজকে। রাত ১০ টায় খোয়াই নদীর তীরের বাড়িটিতে প্রথম গেলেন সরদার আজিজ। ধনাঢ্য পরিবারের বাড়ি ঘর যেভাবে সাজানো থাকার কথা, সেভাবে সাজানো ছিল। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার কিছু সময় পর এলেন সোনাহর আলীর স্ত্রী। তিনি খোঁজ খবর নিলেন সরদার আজিজের। নানান আলাপচারিতায় রাত ১২ টা বেজে যায়। সোনাহর আলী রাতের খাবার থেতে বসলেন সরদার আজিজকে নিয়ে। পূর্বমুখি হয়ে বসতেই খোয়াইনদীর অপরুপ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে। এরই মধ্যে সেখানে এসে হাজির হলেন সোনাহর আলীর শ^াশুরি। সাথে সোনাহর আলীর যুবতী কন্যা। শ^াশুরিকে সোনাহর আলী জানালেন, সরদার আজিজকে পরীক্ষা করছিলাম। পরীক্ষায় একশতে এক’শ পেয়েছে। এসময় সোনাহর আলীর শ^াশুরি অনেকটা রসিকতা নিয়ে কথা বলছিলেন। সবাই মিলে সরদার আজিজকে আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সরদার আজিজ নিজ সিদ্ধান্তে অটল। রাত গভীর হয়ে আসে। বিদেয় নিয়ে চলে আসেন সরদার আজিজ। পরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে প্রস্তুতি নেন ফেঞ্চুগঞ্জ যাওয়ার জন্যে। মুখোমুখি হন সোনাহর আলীর। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সোনাহর আলী এক সময় সরদার আজিজকে বললেন তোমার যত টাকা প্রয়োজন ম্যানেজারকে বলে নিয়ে নেও। সরদার আজিজ জানিয়ে দিলেন তাঁর প্রয়োজন ১০০ টাকা। সে সময় ১০০ টাকার মূল্য অনেক।
ম্যানেজারের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেন সরদার আজিজ। রওয়ানা হন ফেঞ্চুগঞ্জের উদ্দেশ্যে। ওইদিনই পৌঁছে যান ফেঞ্চুগঞ্জে। সেখানে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ইন্টারভিউয়ের বাকি কয়েকদিন। কিন্তু সরদার আজিজ সেখানে অবস্থান করে নিয়োগের বিষয়টি পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। চাকরির বাজার অনেক জটিল। কিন্তু তাঁকে চাকরি পেতে হবে। নানানভাবে খবর নিচ্ছেলেন তিনি।
সরদার আজিজ জানান, ৭৪ সালের শেষ দিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির লিখিত পরীক্ষার ডাক পড়ে। যথা সময়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এই পরীক্ষায় ৪০০ জনের উপরে প্রার্থী ছিলেন। পরীক্ষা ভালোই হলো। কয়েকদিন সরদার আজিজের ফলাফল নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন বলে অনেকের মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এবার মৌখিক পরীক্ষার পালা। মৌখিক পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছেন ৫০ জন। ফেব্রæয়ারি মাসে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার চিঠি ইস্যু হয়। পরীক্ষায় অংশ নিতে গেলেন সরদার আজিজ। কিন্তু ৫০ নম্বর তালিকায় নাম দেখে মেজাজ বিগরে যায়। মেজাজ ঠান্ডা করে অপেক্ষা করতে থাকেন।
সবাই চলে গেছেন মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে। বিকেল চারটায় ডাক পরে সরদার আজিজের। ইন্টারভিউ বোর্ডে গেলেন। বোর্ডের এক সদস্য বসতে বললেন সরদার আজিজকে। একজন সদস্য সরদার আজিজকে জানালেন দুইটি প্রশ্ন করা হবে। দুইটির উত্তর করতে পারলে চাকরিতে যোগদানের বাধা নেই। একটির উত্তর দিলে বোর্ডের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন চাকরি দেয়া যায় কিনা। আর দুইটির উত্তর না পারলে চাকরি হবে না। এই বলে একজন সদস্য রাইফেল সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। সঠিক উত্তর দেন সরদার আজিজ। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল নকশা সম্পর্কে। সঠিক উত্তর দিলেন। ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে জানিয়ে দেয়া হলো সরদার আজিজের চাকরি প্রায় নিশ্চিত।
সরদার আজিজ জানালেন তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার একজন আত্মীয়র বাসায় থাকতেন। কিন্তু ওই আত্মীয় সরদার আজিজকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারতেন না। কারণ ওই আত্মীয় ছিলেন মুসলিমলীগার ছিলেন। কয়েকদিন পর সরদার আজিজ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি হন। এদিকে মার্চ মাসে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা কর্তৃপক্ষ বাছাই করা ৮ প্রার্থীর নামে যোগদান চিঠি ইস্যু করেন। অফিস পিওন ওই যোগদান পত্র নিয়ে প্রার্থীদের বাসা বাড়িতে পৌঁছে দিতে থাকেন। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সরদার আজিজুর রহমানকে।
আত্মীয়র বাসায় পত্র নিয়ে যান পিওন। কিন্তু আত্মীয় পত্র রাখতে অপারগতা প্রকাশ করে। যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সরদার আজিজ ভর্তি ছিলেন ওই হাসপাতালের ডা. আলীর কাছে খবরটি পৌঁছে যায়। তিনি সারকারখানার প্রশাসন বিভাগে ফোন করে জানিয়ে দেন সরদার আজিজ অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অফিস পিওন যোগদান পত্র নিয়ে হাজির হন হাসপাতালে। যোগদান পত্র তুলে দেন সরদার আজিজের হাতে। পত্র পেয়ে হাসপাতালের নার্সের হাতে তুলে দেন মিষ্টি খাওয়ার টাকা। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ মার্চ নতুন কর্মস্থল ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় যোগদান করেন সরদার আজিজ। ১ এপ্রিল থেকে শুরু করেন কর্মদিবসের প্রথম দিন।