দ্রুতগতিতে পদ্মা পারাপারে একসময় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাঝিকান্দি নৌরুটে যাত্রীদের ভরসা ছিল স্পিডবোট। এ নৌঘাটে ব্যস্ততাও ছিল দিনভর। ঈদের ছুটিতে দেখা যেত উপচেপড়া ভিড়। দেড় শতাধিক দ্রুতগতির এসব নৌযান প্রতিনিয়ত নদীতে ঢেউয়ের ঝড় তুলে যাত্রী পারাপার করতো। তবে পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে এসব নৌযান রীতিমতো মালিকপক্ষের কাছে জঞ্জাল বা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনেকেই বিক্রি করছেন নৌযান। তবে অর্ধেক দামও মিলছে না। এতে বেকার হয়ে পড়ছেন স্পিডবোটের চালকরা। জীবিকার তাগিদে পেশা পাল্টানোর চিন্তা করছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ফেরিতে দেড় ঘণ্টা আর লঞ্চে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে নদী পারাপারে। এর বিপরীতে স্পিডবোটে শিমুলিয়া-মাজিকান্দি রুটে ১০ থেকে ১২ মিনিট বাংলাবাজার রুটে সময় লাগতো ১২ থেকে ১৫ মিনিটে। দ্রুতগতিতে নদী পারাপারে তাই যাত্রীদের প্রথম পছন্দ ছিল স্পিডবোট। তবে এখন পদ্মা সেতু হওয়ার পর যাত্রীর দেখা নেই বললেই চলে। যাত্রী সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে চলাচল। এখন কেবল শিমুলিয়া থেকে মাঝিকান্দি নৌরুটে অল্পসংখ্যক নৌযান চলছে।
সূত্রে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষের দশকে পদ্মায় যাত্রী পারাপার স্পিডবোটের ব্যবহার শুরু হয়। প্রায় তিন দশক ধরে ভালোই চলছিল এই ব্যবসা। বোটের সংখ্যা কয়েকশোতে দাঁড়ায়। সর্বশেষ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও ডিজি শিপিংয়ের তৎপরতায় নিবন্ধন করে ১৫৫টি নৌযান। তবে নৌরুটের তিন দশকের এই পেশা এখন হারিয়েছে প্রয়োজনীয়তা।
সরেজমিন দেখা যায়, শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটে এখন অনেকটাই সুনসান নীরবতা। ঘাটে ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক স্পিডবোট নোঙর করা। ২০-২৫টি বোট ঘাটের পূর্বদিকে নদীর পাড়ে তুলে রাখা হয়েছে। কেবল কয়েকজন চালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এখনো ঘাটে আছেন। মাঝে মাঝে দুই-একজন যাত্রী আসছেন। তবে তাদের অধিকাংশ ফিরে যাচ্ছেন। আগে প্রতিদিন যেখানে চার-পাঁচ হাজার যাত্রী পারাপার হতো, যে কোনো ছুটি ও ঈদের সময় যাত্রী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতো ২০-২৫ হাজারে, সেখানে এখন প্রতিদিন শতাধিক যাত্রীও হচ্ছে না।
স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার পক্ষের ইনচার্জ হাবিব বলেন, শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার স্পিডবোট চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কেবল মাঝিকান্দি রুটে কয়েকটি স্পিডবোট চলে। যাদের বাড়ি জাজিরা প্রান্তের নদীপাড়ে তারাই কেবল পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। বর্তমানে সারাদিনে সর্বোচ্চ সাত-আটটি স্পিডবোট চলাচল করে। শুক্রবার কিংবা ছুটির দিনে কিছু পর্যটক ঘুরতে আসে। এছাড়া তো কোনো যাত্রীই নেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব বোট এখানে ওখানে নোঙর করে রাখছি। কাজ নেই কী করবো। বোটের তেল ভরার জন্য যে দোকান ছিল তারাও এখন ব্যবসা ঘুটিয়ে নিচ্ছে। করুণ অবস্থা সবার।
বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের মো. শাহিন পদ্মায় স্পিডবোট চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। ১৫ বছর ধরে স্পিডবোট চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা এই ব্যক্তি এখন বেকার।
তিনি বলেন, চার সদস্যের পরিবার। ১৫ বছর ধরে স্পিডবোট চালিয়ে সংসার চালাচ্ছি। আগে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা আয় হতো। এখন যাত্রীও নেই, আমাদের কাজও নেই। বেকার হয়ে পড়েছি। পরিবার চালাতে কষ্ট হচ্ছে, অন্য কোনো কাজের সন্ধান করছি।
সুমন জানান, অধিকাংশ স্পিডবোট চালকদের অবস্থায় তার মতো। জীবনের তাগিদে এখন যে যেখানে পারছেন কাজের সন্ধান করছেন।
সাড়ে তিন লাখ টাকা মূল্যের স্পিডবোট এখন অনেকটাই গলার কাঁটা বলে জানালেন মাওয়া এলাকার মো. বাদশা। তিনি বলেন, ৪০ সিসি ইঞ্জিনের বোট আমার। নিজের বোট নিজেই চালাই। সকাল থেকে ঘাটে এসে বসে থাকি, কোনো ট্রিপ পাই না। আগে সারাদিনে নিয়ম করে দুই-তিনটা ট্রিপ পেতামই। এখন তো আর চলে না, অন্য চিন্তাই করতাছি (পেশা বদলের)। ১৫ বছরের বেশি সময় হইলো এই লাইনে আছি, এখন তো জিরো।
সুমন, বাদশার মতো এক ডজন চালকের সঙ্গে কথা হয়ে প্রতিবেদকের। সবাই জানান, অনেকটা একই অবস্থা কথা।