মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গারো সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান ধর্মীয় 'ওয়ানগালা' নবান্ন উৎসব হয়েছে। গারো জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস, ‘মিশি সালজং’ বা শস্যদেবতার ওপর ভরসা রাখলে ফসলের ভালো ফলন হয়।
দেবতাকে নতুন ফসলের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতি চেয়ে তারা এই উৎসব করেন। উৎসবের মূল উদ্দেশ্য আগামী বছরে যেন ফসল ভালো হয়। তাদের সন্তান ও পরিবার-পরিজনরা যেন ভালো থাকে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী গারোদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টির অন্যতম উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ থেকে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে আয়োজন করা হয়। তাই বরাবরের মতো এবারও নানা আয়োজনে শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া চা বাগান মাঠে সকালে এ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
দিনব্যাপী উৎসবে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে অংশ নেন শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গারো সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষ। তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী নানা রঙের নিজস্ব পোশাকে উৎসবে হাজির হন। এ সময় নতুন ফসল ঘরে তোলার বিভিন্ন অনুসঙ্গসহ নৃত্য-গীতের মধ্যে দিয়ে শিল্পীরা উপস্থাপন করেন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। অনেকে সুপারী, ধান, নারিকেল, পেঁপে, কচুসহ বিভিন্ন ফসলাদি দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করেন।
ওয়ানগালা উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসলাম উদ্দিন, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সালাউদ্দিন বিশ্বাস, জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য প্রীতম দাস প্রমুখ।
উৎসবের প্রথম পর্বে ক্রুশ চত্বরে বাণী পাঠ, খামালকে খুথুব ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্কা দেওয়া, পবিত্র খ্রিষ্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনা সভা ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। মূলত এ অনুষ্ঠানটি গারোদের হলেও খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরা সেখানে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে তাদের পুরোহিত জংসন ম্রি (খামাল) মোরগ কেটে এর ভেতরের খাদ্যনালী দেখে আগামী বছর কেমন যাবে ভবিষৎবাণী করেন। পুরোহিত মোরগের খাদ্যনালী দেখে বলেন, দেশ দুঃসময় কাটিয়ে ভালো দিকে এগুচ্ছে। এ বছর দেশে শস্য উৎপাদন ভালো হবে। মানুষের মেলবন্ধন সুদৃঢ় হবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গভীর হবে। এতে সংসার জীবনে উন্নতি আসবে।
‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে নতুন খাদ্যশস্য খাওয়া নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্য। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন।
ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও আয়োজন করা হয় তাদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। বিশেষ প্রার্থনা শেষে ছিল গারোদের নিজস্ব ঐতিহ্যের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারো কিশোরীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী গান ‘ওয়ানগালা ওয়ানগালা’ গানের সঙ্গে নৃত্য করেন। ফুলছড়া চা বাগান মাঠে ওয়ানগালাটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। তিনদিনব্যাপী আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও নানা কারণে এখন দুদিনেই পালিত হয়। গারোরা নিজেদের ‘আছিক মান্দি’ বা ‘পাহাড়ি মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক পছন্দ করে। তবে মৌলভীবাজারের গারোরা নিজেদের শুধুই ‘মান্দি’ বা ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দেয়।
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএ