ঢাকা, বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বছরের শুরুতে সরকারের চমক ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২৫ নভেম্বর ২০২২ ১১:৪১:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

 

 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন বছরের (২০২৩ সাল) প্রথম চমক হবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। যার নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর গভীরে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে যা ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ নামে পরিচিতি। আগামী জানুয়ারিতে এটি খুলে দেওয়া হবে চলাচলের জন্য।

 

 

 শনিবার (২৬ নভেম্বর) টানেলটির দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) ঢাকা থেকে আসা এক দল সাংবাদিক বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন।

 

টানেল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে শুরু হওয়া টানেলটি শেষ হয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে। কর্ণফুলী নদীর ১৫০ ফুট তলদেশে তৈরি বঙ্গবন্ধু টানেলটি সত্যিই এক বিস্ময়। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেতে সময় লেগেছে মাত্র চার মিনিট। এটি চালু হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে সময় ও পথের অনেক সাশ্রয় হবে।

 

এদিকে, প্রকল্প এলাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার জন্য মূলত যেটা বলা হয় আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন, সেই অবকাঠামো উন্নয়নের চূড়ান্ত মাইলফলক হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।

 

 

 ‘প্রধানমন্ত্রী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছেন। তার সঙ্গে দেশীয় বিনিয়োগ আছে, বিদেশি বিনিয়োগও আছে ৷ দেশীয় উৎপাদন বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, একইভাবে বিদেশেও ছড়িয়ে যাবে। সেজন্য দরকার আমাদের ভালো মানের রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও বন্দর। এ টানেলের সঙ্গে মাতারবাড়ির নিবিড় সম্পর্ক আছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাওয়ার ৪০ কিলোমিটার পথ কমে যাবে। এতে সময় বাঁচবে। যারা কাজ করেন, তাদের সময় বাঁচা মানে খরচও কমে যাওয়া।’

 

‘এ টানেল আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশাল অর্জন। আগামী জানুয়ারি মাস থেকে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে’— আশা প্রকাশ করেন মুখ্য সচিব। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছেন, শক্ত ভিত্তি যেটা বলে সেটার ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ভূমিকম্প থেকে রক্ষায় যে ধরনের দালান তৈরি প্রয়োজন, আমাদের অর্থনীতি আল্লাহর রহমতে সেই রকম অবস্থানে আছে।’

 

‘বাংলাদেশে আইএমএফের প্রতিনিধি দল এসে প্রতিটি সেক্টর পর্যালোচনা করে দেখেছে। যদি মার্কিংয়ের হিসাব করা হয় তাহলে বাংলাদেশ পেয়েছে এ প্লাস। এটা কিন্তু এক দিনে হয়নি। বিভিন্ন নীতি, পদ্ধতি ও উন্নয়নমূলক কাজের ফলস্বরূপ এটা হয়েছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য যেসব নীতি ও কৌশল নেওয়ার কথা, সেটা ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের দল সেটা দেখে মুগ্ধ হয়েছে।’

 

 

‘এই যে এগিয়ে যাওয়া, তার একটা নবদিগন্ত অর্থাৎ নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে কর্ণফুলী টানেল। আমি আজ টানেলের মাঝখান দিয়ে এসেছি। একটু আগে শাহ আমানত ব্রিজ পার হয়ে গিয়েছিলাম। সারাজীবন আমাদের কল্পনা ছিল নদী পার হতে হলে ওপর দিয়ে যেতে হবে। নৌকা দিয়ে যেতে হবে, না হলে একটা ব্রিজ দিয়ে যেতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মিত হচ্ছে। আমার বাড়ি পটিয়া। পটিয়া থেকে কর্ণফুলী টানেল দিয়ে এসেছি। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে?’

 

এদিন (শুক্রবার) প্রকল্প এলাকায় উপস্থিত ছিলেন সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন এবং প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে 'ওয়ান সিটি টু টাউন' গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ।

 

দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টিউব দুটি তিনটি সংযোগপথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে। বিপৎকালীন অন্য টিউবে যাওয়ার জন্য ক্রস প্যাসেজ ব্যবহৃত হবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার।

 

 

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন।

 

চীনের এক্সিম ব্যাংক এ প্রকল্পের জন্য পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার ঋণ দেয়। বাকি টাকার জোগান দেয় বাংলাদেশ সরকার। চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠান টানেলটি নির্মাণ করছে। 

 

৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির নিকট হতে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম প্রান্তে (পতেঙ্গা) ০.৫৫০ কিলোমিটার এবং পূর্ব প্রান্তে (আনোয়ার) ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে।

 

এছাড়া আনোয়ারা প্রান্তের সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল সড়ক) রয়েছে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ যত এগিয়েছে ততই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা, আসছে নতুন বিনিয়োগ। পুরোনো অনেক কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। বড় বড় শিল্প গ্রুপ ইতোমধ্যে কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা থেকে কিনে রেখেছে আগাম জমি। সবমিলিয়ে কর্ণফুলী টানেল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ল্যান্ডস্কেপে আনছে বড় ধরনের পরিবর্তন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দেশের নতুন বিজনেস হাব।

 

 

গত চার বছরে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত ৮০টি শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে।

 

টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

 

টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।