বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে জো বাইডেন সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করা ১২ কংগ্রেসম্যানকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনকে চিঠি দেওয়া ডেমোক্র্যাটির পার্টির ছয় কংগ্রেসম্যান ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দেওয়া রিপাবলিকান পার্টির ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি সংগ্রহ করে পৃথকভাবে তার জবাব দিয়েছেন মন্ত্রী। এসব চিঠিতে তিনি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি এই ১২ কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বৈঠকের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
রবিবার (৯ জুলাই) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমন তথ্য জানানো হয়। চিঠি দেওয়ার আগে ১২ কংগ্রেসম্যানের ওই চিঠির সত্যতা সম্পর্কেও নিশ্চিত হয় বাংলাদেশ সরকার।
সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লেখা চিঠি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস ১২ জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের দফতরে ইতোমধ্যে পাঠিয়েও দিয়েছে।
কংগ্রেসম্যানদের চিঠি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে উল্লেখে করে সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, চিঠির উত্তর তো হোয়াইট হাউজ দিয়ে দিয়েছে। হোয়াইট হাউজ বলেছে, তাদের কংগ্রেসম্যান-সিনেটররা অনেক সময় প্রেসিডেন্টকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠিগুলো আমরা গোপনে পড়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে তার উত্তর জানিয়ে দেই। এই চিঠির ক্ষেত্রেও তারা সেটা জানিয়ে দিয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তা আমাদের কেন জানা দরকার- এ বিষয়টিও হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র ব্যাখ্যা করেছেন।
চিঠিটি কোনোভাবে লিক হয়েছে এমনটা জানিয়ে সভাপতি বলেন, এই চিঠির বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রদূত স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ব্রিফ করেছেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে চিঠির মাধ্যমে উত্তর দিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে।
মানবাধিকার ও নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, আমরা সবাইকে জানিয়েছি। বারবার জানিয়েছি যে বাংলাদেশে তারা যে ল্যাক অব ডেমোক্র্যাসি, হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন এবং এই ধরনের কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তার প্রতিটির জবাব দিয়েছি। আমরা প্রমাণসহ দিয়েছি কী কী হয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ দলিল এখন আছে। আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় ওইভাবে নির্বাচন হবে।
নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যের কোনও পরামর্শ থাকলে তা নির্বাচন কমিশনের কাছে জানানোর পরামর্শ দিয়ে সরকারি দলের এই সিনিয়র এমপি বলেন, তাদের নির্বাচন নিয়ে যদি কোনও কিছু বলার থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের দেশের নির্বাচনের গুড প্র্যাকটিস রয়েছে, সেটা আমাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে এর থেকে তারা কিছু নেবে তারা তা নিতে পারে। আমরা তাদের বলেছি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে। তারা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাইলে পাঠাতে পারে। যতদূর জেনেছি তারা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে। তারা যদি পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায় সেটা পাঠিয়ে বাংলাদেশের ডেমোক্র্যাটিক প্রসেস, ইলেকশন প্রসেস তারা চাইলে দেখতে পারে।
সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৮ জুন মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ছয় কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পত্র লিখেছেন। এছাড়া, ২৫ মে মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির ছয় কংগ্রেসম্যান একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট এন্টনি জে. ব্লিঙ্কেনের কাছে পত্র দিয়েছেন। রিপাবলিকান পার্টির ওই কংগ্রেসম্যানরা বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন অতীতে এমন নজির দেখা যায়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ওই চিঠি দুটির কোনোটিই বাংলাদেশ দূতাবাস তথা বাংলাদেশ সরকার বরাবর লেখা হয়নি। এরপরও বাংলাদেশ দূতাবাস ওই চিঠির অনুলিপি সংগ্রহ করে এবং সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কংগ্রেসম্যানদের দফতরে যোগাযোগ করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ দূতাবাস ওই ১২ কংগ্রেসম্যানের একাধিকের দফতরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছে ও তাদের পত্রের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এবং হোয়াইট হাউজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিশেল জে. সিসন, আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক অ্যাম্বসেডর অ্যাট লার্জ রাশাদ হুসেইন, হোয়াইট হাউজ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক রিয়ার এডমিরাল এইলিন লাউবাচার, দক্ষিণ ও সেন্ট্রাল এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড ল্যু এবং একই ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তারের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে ওই চিঠি দুটিতে কিছু ভ্রান্ত ধারণা এবং অসত্য তথ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে উল্লেখ করা হয়। এসব ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত।
ওই ১২ মার্কিন কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বৈঠক আয়োজনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতোমধ্যে একাধিক কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে বৈঠক চূড়ান্ত হয়েছে।
এদিকে ইইউ পার্লামেন্টের ৭০৫ সদস্যের মধ্যে ছয় জন গত ১২ জুন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি/ ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ঔড়ংবঢ় ইড়ৎৎবষষ ঋড়হঃবষষবং-এর কাছে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এই চিঠিতে নির্দিষ্টভাবে একটি রাজনৈতিক দলের উল্লেখ রয়েছে এবং তা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই প্রতীয়মান হয়। চিঠির বক্তব্য একান্তই ওই ছয় জন পার্লামেন্ট সদস্যের ব্যক্তিগত মতামত বলেই ঢাকার ইইউ ডেলিগেশন মন্তব্য করেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটি ইইউর অফিসিয়াল বক্তব্য নয় বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনও জবাব দেয়নি বলেও সংসদীয় কমিটিকে জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সংক্রান্ত নানা অপপ্রচার রোধে এবং উন্নয়নযাত্রাকে তুলে ধরতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ দূতাবাস ব্রাসেলস এবং ঢাকার ইইউ ডেলিগেশনের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ইইউর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। ইধহমষধফবংয ঈরারষ ঝড়পরবঃু রহ ঊঁৎড়ঢ়ব ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টকে ৩১৫ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে ২৩ জুন চিঠির মাধ্যমে প্রত্যেকটি ইস্যুতে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তারা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ অপপ্রচারের’ প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলে অনলাইন নিউজপোর্টাল ঊট জবঢ়ড়ৎঃবৎ-এ প্রকাশিত হয়েছে।
কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খানের সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মো. আব্দুল মজিদ খান, কাজী নাবিল আহমেদ ও নিজাম উদ্দিন জলিল (জন) অংশ নেন।