বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের নির্বাচনী পরিবেশ ও কাঠামো বিষয়ে সরেজমিন দেখতে আজ ‘ইলেকশন এক্সপ্লোরেটরি মিশন’ বা ‘নির্বাচনবিষয়ক অনুসন্ধানী মিশন’ শুরু করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। এ উপলক্ষে গতকাল দুই দফায় ঢাকায় এসেছেন ইইউয়ের এই অগ্রগামী দলের ছয় সদস্য। ছয় সদস্যের এ দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ইতালীয় নাগরিক রিকার্ডো চিলিলিয়ার। মূলত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আমন্ত্রণে আসা ইইউ প্রতিনিধি দলটি ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে। তাদের প্রাপ্ত তথ্য ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে ইইউয়ের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের কাছে। এ প্রতিবেদন থেকেই নির্ধারণ হবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না।
ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন প্রধানের কার্যালয়সূত্র জানান, ইইউয়ের বিশেষ মিশনের দুজন কর্মকর্তা গতকাল দুপুরেই ঢাকা এসে পৌঁছান। বাকি চারজন ঢাকা আসেন গত রাতে। আজ দুই সপ্তাহের জন্য তারা কাজ শুরু করবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ইইউ মিশন ঢাকায় অবস্থানকালে সরকারের বেশ কয়েকটি দফতরের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এ ছাড়া এ মিশনের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন। তারা বিভিন্নভাবে কথা বলবেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও সুশীলসমাজের নানান অংশের সঙ্গেও। বৈঠক হবে বাংলাদেশে কাজ করা বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও। তারা মূলত দুটি বিষয়ের ওপর জোর দেবেন। একটি হচ্ছে নির্বাচনের আগে এ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং অন্যটি নির্বাচনী কাঠামো। ইইউয়ের মিশন সম্পর্কে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, এ মিশনটি একেবারেই নির্বাচনকেন্দ্রিক। তারা এখানে অনুসন্ধান চালাবে। এখানেই তারা নির্ধারণ করবে যে ইলেকশন অবজারভার মিশন পাঠাবে কি পাঠাবে না। ইইউ প্রতিনিধি দলটির কার্যক্রম সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম জানিয়েছেন, এ মিশনের কাজ হবে মূলত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, লজিস্টিকস, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যায়ন করা। পাশাপাশি তারা সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সুশীলসমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করতে ইচ্ছুক বলে ঢাকাস্থ ইইউ ডেলিগেশন জানিয়েছে। অনুসন্ধানী মিশন থেকে পাওয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন (ইওএম) পাঠানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে এ সফর হবে বলে এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করণীয় নেই। নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, প্রতিনিধি দল ১১ জুলাই সকালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবে। সে সময় তারা নির্বাচনসংক্রান্ত যেসব বিষয় জানতে চাইবে তা তাদের জানানো হবে।
কূটনৈতিক সূত্রের খবর, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও সব অংশীজনের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর সদস্য দেশগুলো। এরই অংশ হিসেবে তারা আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। গত জাতীয় নির্বাচনে তারা বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। মূলত ইইউ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারচর্চা এবং সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জানতে চাইবে নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি না। দলগুলোর মুখ থেকেই তারা এ বিষয়ে বক্তব্য চাইবে। এর আগে ইইউয়ের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ও ঢাকার ডেলিগেশনের প্রধান একাধিকবার বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। ইইউ বিশ্বাস করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতিতে বদলে যেতে পারে। এজন্য নির্বাচনী কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এদিকে, যে জোসেফ বোরেলের কাছে অনুসন্ধানী মিশন প্রতিবেদন জমা দেবে, সেই জোসেফ বোরেল তাঁর কাছে সম্প্রতি লেখা ইইউ পার্লামেন্টের ছয় এমপির একটি চিঠির জবাব দিয়েছেন। ইইউ পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল চিঠির উত্তরে লিখেছেন, বাংলাদেশ সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পরিস্থিতি, উপকারিতা ও সম্ভাব্যতা পর্যালোচনার জন্য তথ্যানুসন্ধান মিশন পাঠানো হয়েছে। জোসেফ বোরেল নির্বাচনে সব অংশীজনের ভূমিকার কথা তুলে ধরে লিখেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা সৃষ্টির জন্য সব অংশীজনকে ভূমিকা রাখতে হবে। আর সেজন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপ এবং নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মৌলিক স্বাধীনতাগুলোর সুরক্ষা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল্যবোধ ও নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গন সরব হয়ে উঠেছে। বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে একের পর এক বক্তব্য-বিবৃতি আসছে। ইইউয়ের এ মিশন চলাকালেই ১১ জুলাই ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক নিরাপত্তা বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তাঁর সঙ্গে থাকবেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। মার্কিন প্রতিনিধিদের এ সফরেও অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে নির্বাচন নিয়েই আলোচনা হবে।