বরিশালে দলের মেয়র প্রার্থী নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের ওপর হামলার পরপরই রাজনৈতিক ইউটার্ন নিয়েছে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। প্রতিবাদে গুটিয়ে নিয়েছে সরকারের অধীনে হওয়া সব ধরনের নির্বাচন থেকে। রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। আসন্ন ১৭টি পৌরসভা নির্বাচনেও অংশ নেবে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন জাতীয় সরকারের অধীনে চায় ইসলামী আন্দোলন। দলটি বলছে, ক্ষমতাসীনদের মারমুখী আচরণে ক্ষুব্ধ তারা। তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ নির্বাচন কমিশনের ওপর। এই কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে আগামী ২১ জুন বুধবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবন ঘেরাও করা হবে। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন চাই।’
জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সরকারের নমনীয়তার দৃষ্টান্তও দেখা গেছে। গত জানুয়ারিতে ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এছাড়া মাঠের কর্মসূচিতেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর মতো কখনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। চালিয়ে গেছে দলের স্বাভাবিক কার্যক্রম। সরকারের গুডবুক বা করিডোরে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন এমন গুঞ্জন ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে সেই দৃশ্যপট হঠাৎ করেই বদলে গেছে। বিশেষ করে বরিশাল সিটি নির্বাচনের দিন থেকে চেহারা বদলে গেছে। দ্বিতীয় শীর্ষনেতা মুফতি ফয়জুল করিমের ওপর সরাসরি আঘাত আসে। হাতপাখার প্রার্থীর রক্তাক্ত হওয়াটা ‘আপেক্ষিক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এতে চরম ক্ষুব্ধ হন দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তারা এখন এই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সিইসির পদত্যাগ দাবি করছে। মাঠেও আন্দোলন করছে। সব ধরনের নির্বাচন বয়কট করারও কথা বলছে। সূত্র বলছে, ভোটের আগে ইসলামী আন্দোলনকে পাশে রাখতে চাইছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। তাদের দাবি, ইসলামী আন্দোলনে ভোট ইদানীং সবখানে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরের তুলনায় ভোট বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক জায়গায় আমাদের জনপ্রতিনিধি আছে। তবে দলটি কারও সঙ্গে জোট যাবে না। বরং সরকার পতনের আন্দোলন আরও জোরালো করা হবে। ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া উপ-কমিটির সহকারী সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম কবির বলেন, জাতীয় নির্বাচন হতে হবে জাতীয় সরকারের অধীনে। যেখানে সব দলের প্রতিনিধি থাকবেন। তাদের সমন্বয়ে নির্বাচন পরিচালিত হবে। সেখানে ক্ষমতাসীনরাও থাকবেন। কিন্তু জাতীয় সরকারের প্রতিনিধিরা কেউ ভোট করতে পারবে না। হাতপাখা সেই লক্ষ্যে মাঠের আন্দোলন জোরালো করবে। বিএনপি কিংবা অন্য কারও সঙ্গে না গিয়ে এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
হাতপাখা এখন কোন পথে হাঁটছে জানতে চাইলে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, আমরা নিজস্ব পথেই হাঁটছি। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আমরা তাদের অধীনে ভোটে যাব না। ২০১৪ সালেও যাইনি। এই নির্বাচন কমিশন আগেরগুলো থেকেও ব্যর্থ। জাতীয় সরকারের অধীনে হতে হবে জাতীয় নির্বাচন। এদিকে, গতকাল রোববার রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে তাদের দল আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণকারী রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের অধীনে আমরা নির্বাচন করব না। ক্ষমতাসীনরা এবারও জাতীয় সংসদ বহাল রেখে গায়ের জোরে তাদের অধীনেই আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চায়। জোরপূর্বক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে সরকার পতনের আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও জানান।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং আবারও ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনের মতো নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে। রাতের ভোটে নির্বাচিত বর্তমান সংসদের কোনো নৈতিক বৈধতা নেই। আমরা বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন চাই।’
রেজাউল করীম আরও বলেন, ‘বর্তমান বিতর্কিত সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ প্রায় শেষ প্রান্তে। আমরা চাই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পালা বদল হোক। কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। শিগগিরই ইসলামী আন্দোলন প্রতিনিধিত্বশীল, দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক দল এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবে।’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করে রেজাউল করীম বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য একজন কাণ্ডজ্ঞানহীন বিকারগ্রস্ত মানুষ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে বসে আছেন। অবিলম্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের পদত্যাগ বা অপসারণ চাই। সিইসির পদত্যাগ ও ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন বাতিলের দাবিতে আগামী বুধবার সকাল ১০টায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয় অভিমুখে গণমিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে বরিশালে মুফতি ফয়জুল করীমের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি করেন তিনি। সুষ্ঠু নির্বাচনে ৮ দাবি ও ৫ প্রস্তাবনা: সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশায় ৮ দফা দাবি ও ৫টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন রেজাউল করিম। দাবিগুলো হলো- যে কোনো মূল্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা ও লোডশেডিংয়ের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে; কারাবন্দি সব মজলুম আলেম ও রাজবন্দির মুক্তি; কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন; সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বরিশালে মুফতি ফয়জুল করীমের ওপর আক্রমণকারী সন্ত্রাসী, নির্দেশদাতা এবং ভোট ডাকাত ও দস্যুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল; সভা-সমাবেশসহ সংবিধান স্বীকৃত সব রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বাকস্বাধীনতা উন্মুক্ত; সরকারের নির্বাহী আদেশে বন্ধ সব টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র অবিলম্বে চালু; সব সাংবাদিক হত্যার দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এ সময় শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ৫টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তা হলো- জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতীয় সরকার গঠন করা; জাতীয় সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে; প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন; জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার পরবর্তী তিন বা ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বর্তমান মন্ত্রিসভার কেউই নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারে থাকতে পারবেন না ও জাতীয় সরকারে যারা থাকবেন তারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানি, মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজী, মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইমতিয়াজ আলম প্রমুখ।