ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ক্রসফায়ার বাণিজ্য ছিল ওসি প্রদীপের নেশা!

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ৩১ জানুয়ারী ২০২২ ১১:২১:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি টেকনাফ মডেল থানায় যোগদানের পর থেকে মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তিনি অবৈধভাবে পেশিশক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন।

 কিছু দিন যেতে না যেতেই তাকে টাকার নেশায় পেয়ে বসে। ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়াও আর্থিকভাবে সচ্ছল নিরীহ পরিবারগুলোকে টার্গেট করেন প্রদীপ। এর পর তাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে, অনেক লোকজনকে ক্রসফায়ার দিয়ে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন।

 ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

 কক্সবাজারের মহেশখালী থানা থেকে ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে ওসি হিসেবে টেকনাফ মডেল থানায় যোগ দেন প্রদীপ।

অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় যোগদানের পর তার নেতৃত্বে ও নির্দেশে শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বহুলোকের মৃত্যু হয়েছে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধ প্রক্রিয়া ছিল কোনো ঘটনায় মাদক উদ্ধার হলে অথবা টার্গেট কোনো ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হলে (ফিটিং মামলা) প্রথমত আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন। এর পর স্থানীয় কিছু শ্রেণির লোকজনসহ তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের জন্য দেনদরবার করা হয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ক্রসফায়ার না দেওয়ার শর্তে আদায় করা হতো। প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ আশানুরূপ বা চাহিদা অনুযায়ী হলে ভিকটিমকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে ওই ব্যক্তির বা আসামির আত্মীয়স্বজনদের মামলার আসামি করা হতো।

এ ক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী কেউ তার আক্রোশ থেকে রেহাই পেত না। এমনকি নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও করা হতো বলে তদন্তে জানা যায় এবং এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আদালতে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর পর শুরু হতো তার অন্যরকম অবৈধ অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ তার দায়ের করা মামলার কথিত এজাহারে বর্ণিত আসামিদের ক্রসফায়ারের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ আসামির সৃজিত সম্পত্তি বেদখল করে এবং ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা।

এ কাজ করার জন্য তিনি (প্রদীপ) তার সমমনা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব পেটুয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, প্রদীপের এ ধরনের অপরাধকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। যারা ন্যূনতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন, তারা এবং তাদের পরিবার ও নিকটাত্মীয়স্বজন তার অত্যাচার, নিপীড়নসহ মামলা-হামলার শিকার হতো। তিনি টেকনাফ মডেল থানায় যোগদান করেই স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন।

মাদক নির্মূলের অজুহাতে ও নিজেকে সরকারের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক দেখানোর আড়ালে জনগণ তথা সরকারি দলমতের তোয়াক্কা না করে, পুরো থানা এলাকায় এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে, সমাজ ও জনপদে ত্রাস সৃষ্টি করে অপরাধের অভয়ারণ্য ও অপরাধকর্মের রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলে জানা যায়। তার এ ধরনের অপরাধকর্মের প্রচার ও প্রসার রোধে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার দলবল স্থানীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে রাখতেন বলে জানা যায়।

এতেও কাজ না হলে ভয়ভীতি-হুমকি প্রদর্শনসহ মামলায় জড়িয়ে কণ্ঠরোধ করা হতো। তার কুকর্মের বিষয়ে কেউ যাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে এবং প্রচার করতে না পারে, সে বিষয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন সোচ্চার ও সতর্ক এবং এ ধরনের লোকজনের তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি তার থানায় এলাকাভিত্তিক সোর্স নিয়োগ করে রাখতেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ওসি প্রদীপ একজন নরপিশাচ। সে মাদক নির্মূলের নামে ক্রসফায়ার দিয়ে ২০৪ জন মানুষ হত্যা করেছে।

তিনি বলেন, অপকর্ম জেনে ফেলায় মেজর সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ওসি প্রদীপ, যা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করি প্রদীপ-লিয়াকতসহ জড়িত সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করবেন আদালত।