ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ইংরেজি নববর্ষ-২০২৫ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো নিছক সৌজন্যমূলক বার্তা নয়; বরং এটি বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করে। শেখ হাসিনার প্রায় দেড় দশকের শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন এবং হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্কের গতিপথ পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। মোদির এই শুভেচ্ছাবার্তা কি সেই পরিবর্তনেরই প্রতিফলন? এই প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাধারণ মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
হাসিনা শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: একটি পটভূমি
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক অভূতপূর্ব উষ্ণতার মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চুক্তির পর চুক্তি হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, মৈত্রী ট্রেন চালু, এবং ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান। হাসিনা সরকারের এমন ভূমিকার কারণে ভারতের নীতি নির্ধারকদের কাছে তিনি ছিলেন 'বিশ্বস্ত মিত্র'।
তবে এই সম্পর্ক একতরফা বলে সমালোচনা করে আসছেন অনেকে। বিশেষত, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আজও বাস্তবায়িত হয়নি, যা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এছাড়া সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি বারবার দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। ভারতীয় পণ্যের দাপটে বাংলাদেশের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগও বারবার উঠেছে।
তবুও হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আপসহীন ছিলেন। এর পেছনে কেবল বন্ধুত্বের নীতি নয়, বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করার বাস্তব রাজনীতি কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
২০২৪ সালের গণআন্দোলন এবং ভারতের ভূমিকা
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেখ হাসিনার সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলন দমন করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং সরকারি বাহিনীর নৃশংস ব্যবহারের ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সরকারের পদত্যাগের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো, অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্বে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে।
এই প্রক্রিয়ায় ভারতের ভূমিকা নীরব হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারত সরাসরি কোনো বিবৃতি দেয়নি, তবে তারা দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। বিশেষত, হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত অধ্যাপক ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকারকে স্বাগত জানায়।
অধ্যাপক ইউনূসকে মোদির শুভেচ্ছা: নিছক সৌজন্য নাকি কৌশল?
নরেন্দ্র মোদির ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতি ভারতের স্বীকৃতিরই ইঙ্গিত বহন করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি চিঠি বা বার্তা পাঠাতে চাইতেন, সেটি নিছক সৌজন্যমূলক বলে উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের প্রতি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানো স্পষ্টতই রাজনৈতিক বার্তা বহন করে।
অধ্যাপক ইউনূস ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন যুগের প্রতীক হতে পারেন কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে ভারতের এই বার্তা প্রমাণ করে যে, তারা কৌশলগতভাবে নতুন বাস্তবতাকে গ্রহণ করেছে।
ভারতের কৌশলগত অবস্থানের পরিবর্তন
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ভারতের জন্য সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকাল ভারতের স্বার্থরক্ষা এবং আঞ্চলিক কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য সুবিধাজনক ছিল। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত দ্রুত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাদের নীতি পরিবর্তন করেছে।
ভারত জানে, বাংলাদেশ তাদের আঞ্চলিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ শুধু একটি মিত্র দেশ নয়; বরং এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি ভারতের ইতিবাচক মনোভাব কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের এক নতুন প্রক্রিয়া।
নতুন সম্পর্কের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হবে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। এই নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা কী হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ।
- তিস্তা এবং পানি ইস্যু
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সদিচ্ছা এই সম্পর্কের একটি বড় পরীক্ষা।
- বাণিজ্যিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। এই বৈষম্য দূর করা এবং বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রপ্তানির সুযোগ বৃদ্ধির দাবি রয়েছে।
- সীমান্ত হত্যা বন্ধ
সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই সমস্যা সমাধানে ভারতকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- চীনের প্রভাব মোকাবিলা
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতকে বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল এবং কৌশলগত মিত্র নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছে। তবে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাসিনার উত্তরাধিকার নিয়ে সমালোচনা থাকলেও তার শাসনামল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে, অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্র্বতী সরকার যে গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এই সরকার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধ্যাপক ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানানো নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটি শুধু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাই নয়, বরং শেখ হাসিনার শাসনামল শেষে ভারতীয় নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিতও।
তবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে উভয় দেশের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, জনগণের চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি এবং আঞ্চলিক কৌশলগত ভারসাম্যের ওপর। ভারত কি সত্যিই হাসিনা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন বাস্তবতা মেনে নিতে প্রস্তুত? সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু স্পষ্ট যে, ভারত এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও কৌশলগত অবস্থান নিতে চাইছে।
বায়ান্ন/এসএ