সিলেট বিভাগে গত কয়েকদিন ধরে ভারী বর্ষণ হয়েছে। ঘটেছে টিলা ও পাহাড় ধসের ঘটনা। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিভাগে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় দেখা দিয়েছে। ফলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায় পানিতে। বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকা।
গত দুদিন ধরে উজানের পানি কমতে শুরু করলেও ভাটিতে বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় সিলেট বিভাগে ২২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সিলেট জেলায় ১৪ জন, হবিগঞ্জে পাঁচজন ও মৌলভীবাজারে তিনজন।
ভয়াবহ বন্যার কারণে বিদ্যুৎ, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা না থাকায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সুনির্দিষ্ট তথ্য এতদিন পাওয়া যায়নি। এসব সচল হওয়ার পরপরই একের পর এক আসছে মৃত্যুর সংবাদ।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২১ জুন) সকালে সিলেটের জৈন্তাপুরে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া মা-ছেলের মরদেহ পানিতে ভেসে ওঠে।
বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় ২০ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তাৎক্ষণিক সর্বশেষ দুজনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য তিনি জানাতে পারেননি।
ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো আশ্রয়কেন্দ্র এবং চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আমরা এ পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। এছাড়া শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৭ লাখ পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং এক লাখ খাওয়ার সেলাইন বিতরণ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকায় পানিতে ভেসে ওঠে নাজমুন্নেসা ও তার ছেলে আব্দুর রহমানের মরদেহ। তারা দরবস্ত ইউনিয়নের কলাগ্রামের বাসিন্দা। তাদের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করেছেন জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল বশিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবারে নাজমুন্নেসা তার ছেলেকে নিয়ে পাশের গ্রামে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। মেয়ের বাড়িতেও পানি ওঠে। সেখান থেকে ফেরার রোববার পথে মা-ছেলে সড়কের পাশে পানিতে তলিয়ে যান। আজ তাদের মরদেহ ভেসে ওঠে।’
কানাইঘাটে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে একজন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার উপজেলার সাতবাক ইউনিয়নের ঠাকুরের ঘাটি এলাকার এক ব্যক্তি হাওরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। পরদিন পানিতে তার মরদেহ পাওয়া যায়।’
শুক্রবার মরদেহ উদ্ধার হলেও এ তথ্য জানা গেছে সোমবার। তবে তার নাম জানাতে পারেননি ওসি। এছাড়া কানাইঘাটে একই পরিবারের সাতজনের মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করছেন অনেকেই। তবে এর সত্যতা নেই বলে জানিয়েছেন ওসি তাজুল ইসলাম।
সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত আজমেরী হক সোমবার জানিয়েছেন, বন্যায় এ পর্যন্ত তিনজন মারা যাওয়ার খবর তিনি জেনেছেন। এর মধ্যে একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও দুজন পানিতে ভেসে গিয়ে মারা গেছেন। এছাড়া পানিতে ভেসে যাওয়া একজন এখনো নিখোঁজ আছেন।
ইউএনও আরও জানান, সোমবার সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ থানার নোয়াপাড়া এলাকার নিজ বাসায় বন্যার পানির ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন মনির হোসেন নামে এক যুবক। শুক্রবার উপজেলার নলকট গ্রামের কলেজছাত্র আব্দুল হাদি পানিতে তলিয়ে যায়। ওইদিনই তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সে সময় আরও একজন পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন।
তবে সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সেলিম আহমদ জানান, পানিতে তলিয়ে উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নে আরও দুজন মারা গেছেন। তারা হলেন ছাত্রলীগ নেতা এ কে আবুল কাশেম ও তার দাদি ছুরেতুন নেছা। তাদের বাড়ি ইউনিয়নের সুজাতপুর গ্রামে।
সেলিম বলেন, ‘আবুল কাশেম তার পরিবারের সঙ্গে নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় বসবাস করেন। বন্যার পানি বেড়েছে জেনে গ্রামের বাড়ি থেকে বৃদ্ধ দাদি ও চাচাতো বোনকে উদ্ধার করতে বৃহস্পতিবার সকালে একটি নৌকা নিয়ে আসেন। দাদিকে নিয়ে শহরে ফেরার পথে সুজাতপুর আইডিয়াল স্কুল এলাকায় পানির স্রোতে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় তার চাচাতো বোন উল্টে যাওয়া নৌকা ধরে প্রাণে বাঁচলেও দাদি-নাতি দুজনই পানিতে তলিয়ে যান। শুক্রবার দাদি ছুরেতুন নেছার মরদেহ ভেসে ওঠে। আর রোববার সকালে আবুল কাশেমের মরদেহ একই জায়গায় ভেসে ওঠে। তাদের মরদেহ দাফন সম্পন্ন হয়েছে।’ তবে এ দুজনের মৃত্যুর বিষয়ে কোনো তথ্য পাননি বলে জানিয়েছেন ইউএনও নুসরাত।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে পানিতে তলিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে ফেসবুকে প্রচার হয়েছে। তবে একে গুজব বলেছেন উপজেলার ইউএনও লুসিকান্ত হাজং। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর তথ্য পাইনি। অনেকে মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছেন। একজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হয়েছিলেন। তবে তিনি এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।’
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে আরও চারজনের মৃত্যুর কথা জানালেও তাদের নাম-পরিচয় এবং কীভাবে কিংবা কোন এলাকার ঘটনা তার সন্ধান মেলেনি।
অন্যদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছৈলা-আফজালাবাদ ইউনিয়নের রাধানগর এলাকার জুনেদ নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ছাতকের ইউএনও মামুনুর রশীদ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাতক পৌরসভার কানাখালী রোডের আখড়া এলাকায় পীযূষ ও জাউয়া বাজার এলাকায় হানিফা বেগম নামে এক স্কুলছাত্রী পানিতে তলিয়ে মারা গেছে। তবে এই দুই ঘটনা ইউএনও নিশ্চিত করেননি। এছাড়া সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও দুজেন মৃত্যুর কথা জানালেও তাদের নাম-পরিচয়, এবং কীভাবে বা কোন এলাকার ঘটনা তার তথ্য পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের আদিত্যের মহাল এলাকায় ঢলের পানিতে গত শনিবার এক শিশু তলিয়ে যায়। রোববার তার মরদেহ ভেসে ওঠে। তবে ওই শিশুর নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এছাড়া উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের আয়েশাবাদ চা বাগানে টিলা ধসে রাজন ব্যানার্জি (৬০) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও একজনের মৃত্যু নিশ্চিত করলেও তার তথ্য মেলেনি।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যাকবলিতদের উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘আমরা কানাইঘাট থেকে অসুস্থ অবস্থায় সাতজনকে উদ্ধার করেছি। তার মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে মৃত্যুর কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি।’