রাজু শেখ। বছর কয়েক আগেও তার পরিচয় ছিল কুলি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বাবার সঙ্গে তরকারির বস্তা টেনে যে সামান্য রোজগার হতো, তাই দিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলতো সংসার। হঠাৎই রাজুর জীবনে আলাদীনের চেরাগ হয়ে ধরা দেয় দেশে শরাণার্থী হিসেবে জায়গা পাওয়া রোহিঙ্গারা। জাল পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তাদের পাসপোর্ট করে দিতে দিতে ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই বনে যান কোটিপতি। নিজের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে গড়ে তুলেছেন কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি, উত্তরায় কিনেছেন ১৬০০ স্কয়ার ফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং রাজউকে নিয়েছেন ৬ কাঠার প্লট।
রোহিঙ্গা ছাড়াও দাগী অপরাধী ও আসামীরাও ছিলেন রাজুর কাস্টমার। জাল জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে তাদেরকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন তিনি। কিন্তু, একাই এই অসাধ্য সাধন করেননি রাজু, এ কাজে তার সঙ্গে জড়িত বড় এক চক্র।
দীর্ঘ তিন মাসের কঠোর অনুসন্ধান শেষে এই চক্রের ২৩ সদস্যকে ধরতে সক্ষম হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আটকদের মধ্যে রাজু শেখ ছাড়াও আছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, যারা পাসপোর্ট করার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।
এরপর শেখ রাজুকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা ও দাগী আসামীদের পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়ে গোপালগঞ্জে কোটি টাকার বাড়ি করেছেন রাজু শেখ। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে কিনেছেন ১৬০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। পূর্বাচলে ৬ কাঠার একটি প্লটও কিনেছেন তিনি।
পাসপোর্ট জালিয়াতি কার্যক্রমের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে রাজু জানান, পাসপোর্ট অফিসের সামনেই তাদের দোকান। সেখানে প্রতিদিন ১০-১৫ জন বাঙালি ফরম পূরণের জন্য আসেন। তখন কৌশলে দীর্ঘ সময় দোকানে বসিয়ে রাখা হয় তাদেরকে। এভাবে যখন ৯-১০ টি ফাইল জমা হয় তখন তাদের সঙ্গে তিনজন রোহিঙ্গার ফাইল মিলিয়ে পাসপোর্টের জন্য জমা দেওয়া হয়।
রাজু আরও জানান, কোনভাবেই যেন ভেতরে কী হচ্ছে, তা যেন কেউ বুঝতে না পারেন সেজন্য পাসপোর্ট করতে আসা রোহিঙ্গাদের নতুন নাম-পরিচয় ধারণে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়ম যেন সবাই একসঙ্গে থাকেন। মানসিকভাবে শক্ত থাকার জন্য রোহিঙ্গাদের বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়। জাল নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্যও আগে-ভাগেই দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। একইসঙ্গে পাসপোর্ট প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের কথায় যেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিকতার কোনো টান না আসে সেটিও নিশ্চিত করা হয়।
প্রায় তিন বছর ধরে এভাবেই অসংখ্য রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট তুলে দিয়েছেন রাজু শেখ। মশিউর রহমান বলেন, ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন এবং পাসপোর্ট জালিয়াতির কাজে জড়ান রাজু শেখ। এর মধ্যে গত তিন বছর ধরে রোহিঙ্গা ও দাগী আসামিদের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।
আর এক্ষেত্রে কক্সবাজার থেকে রাজুকে রোহিঙ্গা গ্রাহক জোগাড় করে দেয় চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির এজেন্টরা। তাদেরকে নিয়ে আসা হয় তার কাছে। এরপর দোকান থেকে ফরম পূরণ করে পাসপোর্ট অফিসে বায়োমেট্রিক করার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় চক্রে জড়িত আনসার সদস্যদের কাছে। সেখান পাসপোর্ট তৈরির বাকি দাপ্তরিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে সহায়তা করেন ওই আনসার সদস্যরা।
তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডায় ধারাবাহিক অভিযান চালায় ডিবির লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটারসহ তিনজন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ ও ১০ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেন ডিবি সদস্যরা। পরে তাদের দেওয়া তথ্য এবং সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ও রাতে কক্সবাজার, টাঙ্গাইল এবং ঢাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে পাসপোর্ট অফিসের দুই আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল চক্রের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারদের হেফাজত থেকে মোট ১৭টি পাসপোর্ট, ১৩টি এনআইডি, ৫টি কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট শত শত দলিলপত্র জব্দ করা হয়।
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদেরকে লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে জন্ম সনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে দিতো শক্তিশালী এই চক্রটি।
এদিকে এই জালিয়াত চক্রের পেছনে আরও কেউ জড়িত আছে কি না সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, পাসপোর্ট জালিয়াতি কিংবা অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কেউ জড়িত আছেন কি না বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। আমার মনে হয় এভাবে হাজার হাজার পাসপোর্ট রোহিঙ্গারা ও দাগী আসামিরা নিয়ে যাচ্ছে।
দাগী আসামিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দাগী আসামিও এভাবে পাসপোর্ট করেছে। তাদের নাম-পরিচয় আমরা তদন্তের স্বার্থে জানাচ্ছি না। গ্রেপ্তারদের আদালতে সোপর্দ করে আবেদন করা প্রেক্ষিতে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও যারা যারা জড়িত তাদের নাম-পরিচয়ও বেরিয়ে আসবে বলে আশা করি।