হাওর অঞ্চলের একটি প্রচলিত কথা রয়েছে, বর্ষায় নাও - হেমন্তে পাও। অর্থাৎ বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে চলাচল করা যায়। পথ-ঘাট ও সেতু পারাপারের মাধ্যমে হাওর অঞ্চলের যোগাযোগের পুরনো দৃশ্যটা অনেকটা পাল্টে গেলেও নৌকার ঐতিহ্য পাল্টায়নি। এখনো হাওরাঞ্চলে নৌকার কদর আগের মতোই আছে। তবে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বর্ষাকালে চলাচলে এখনোও নানা ধরনের নৌকাই প্রধান বাহন।
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সকল হাওরে এখন চারদিকে থইথই পানি। অন্যান্য হাওর অঞ্চলের মতোই এ উপজেলার বেশির ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো নৌকা। উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আক্তাপাড়া মিনাবাজারে প্রায় ৩ যুগ ধরে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন ধরণের নৌকা। একমাত্র নৌকার বাজার হিসেবে প্রতি শুক্রবারে আক্তাপাড়ায় বসে নৌকার হাট। বর্ষাকালে এ নৌকা দিয়ে হাওরে মাছ ধরা, গরুর খাবার সংগ্রহ, যাত্রী পরিবহন করাসহ নানা কাজ করা হয়। বিয়ে অনুষ্ঠানেও প্রয়োজন হয় নৌকার।
জানা যায়, শান্তিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ও দিরাই, জগন্নাথপুর, ছাতক এমনকি কখনো কখনো হবিগঞ্জ, আজমিরিগঞ্জ থেকেও বজরা আসে এ বাজারে। আমতলী, হিল্লা, পাতামী ও বারকী। সাধারণত এ চার ধরণের নৌকা আক্তাপাড়া বাজারে আসে। এসব নৌকা তৈরিতে চাম্বল, আম আর রেইন্ট্রি কাঠ বেশি ব্যবহার করা হয়। নৌকায় গোড়া দেওয়া হয় ৭ থেকে ৯টি। নতুন নৌকার পাশাপাশি পুরোনো নৌকাও প্রায়শই বিক্রি হয় এ হাটে। চার হাজার থেকে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় এসব নৌকা। ভিন্ন ঢঙের গলুয়ের উপর নির্ভর দাম ওঠানামা করে।
বর্ষায় যখন মহাসিং আর সবক'টা হাওর জলগর্ভা থাকে এসময় যাত্রী টানার নৌকা, বড় বড় বজরা আসে এ বাজারে। বর্ষা ছাড়া খুব একটা নৌকার হাট থাকে না। বর্ষায় কিংবা বর্ষা শুরুর কিছুদিন আগে নৌকার বাজার খুব গরম থাকে। এসময় চতুর্দিক থেকেই নৌকা আসে এ বাজারটিতে। সাধারণত পশ্চিম পাগলা, পূর্ব পাগলা, চেচান, সিংচাপই, নোয়াগাঁও, বাউনুগলি, ছাতক সদর, আসামপুর, জিয়াপুর থেকে আলঙ্গীরা নতুন-পুরাতন নৌকা নিয়ে আসেন বাজারটিতে। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ২ শতাধিক নৌকা বিক্রি করা হয়। নৌকার এ বাজারকে কেন্দ্র করে আলাদা করে ৫ শতাধিক মানুষ বেশি আসেন আক্তাপাড়ায়। সপ্তাহের বিশেষ দিনে শুক্রবার অন্যান্য দিনের তুলনায় বিক্রি বাড়ে বাজারে থাকা অন্য ব্যবসায়ীদেরও। নৌকার বাজার এখন এ এলাকার ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি নৌকার বাজারকে কেন্দ্র করে একই দিনে বৈঠার একটি স্বতন্ত্র হাট বসে নৌকা বাজারের পাশে।
শ্রীধরপাশা থেকে নৌকা কিনতে আসা মুস্তাকিম ও স্থানীয় ক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, আক্তাপাড়া মিনাবাজার ঐতিহ্যবাহী একটি নৌকার বাজার। নৌকা বাজারের জন্য বিখ্যাত বাজার এটি। আজকে নৌকা কিনলাম। পাশাপাশি দুইটা বৈটাও কিনলাম। কিনে অনেক ভালো লাগলো। তবে বাজারের আরও রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ করা জরুরি।
ছাতক উপজেলা থেকে নৌকা বিক্রি করতে আসা জায়েদ আলম ও মনু মিয়া বলেন, বর্ষা মৌসুমে সবসময় এ বাজারে নৌকা বিক্রি করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে কারিগর এনে নৌকা তৈরি করাই। পরে এ নৌকাগুলো নিজে এ বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি করি। এ বাজারের একটা সুনাম আছে। এখানে অনেক ক্রেতা পাওয়া যায়।
নৌকা বাজারের ইজারাদার ফরিদ গাজী ও মুরাদ চৌধুরী বলেন, আমরা যৌথভাবে এ নৌকা বাজারের ইজারা নিয়েছি। সুষ্ঠুভাবে নৌকার এ বাজার পরিচালনা করছি। এলাকার সর্বসাধারণসহ উপজেলা প্রশাসনও আমাদের সহযোগিতা করছেন। তবে ঐতিহ্যবাহী এ নৌকার বাজারটির আরও উন্নয়ন করা হোক। এখান থেকে সরকার ভালো পরিমাণে রাজস্ব পাচ্ছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ নৌকা বাজারে অনেক ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়। এ নৌকার বাজার সম্প্রসারণ কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে কোনো সমস্যা হলে কর্তৃপক্ষ আমাকে জানালে সেটা নিরসনে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবো।