ঢাকা, রবিবার ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯শে পৌষ ১৪৩১
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে

সরিষাবাড়ীর ‘প্যারা সন্দেশ’ যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার নানা উন্নত দেশে

কামরুল হাসান, জামালপুর: | প্রকাশের সময় : রবিবার ১২ নভেম্বর ২০২৩ ০২:৩৭:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

কথায় আছে- ‘পেটে খেলে পিঠে সয়।’ মানে বাঙালির পেটে খাবার পড়লে যত কষ্টের কাজই হোক না কেন সেটা সইতে আর কষ্ট মনে হয় না। ভোজন রসিক বাঙালির ক্ষেত্রে তো আর কোন কথাই নেই। তাই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির খাদ্য তালিকায় মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবারের গুরুত্ব অনেকটা বেশিই বহন করে আসছে। জন্মদিন, সুন্নাতে খাতনা, বিবাহসহ যেকোনো শুভ সংবাদে পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনের মাঝে মিষ্টি বিতরণ বাঙালির চিরায়ত প্রথা। আর অনেক রকম মিষ্টির ভীড়ে দীর্ঘদিন ধরে স্ব-মহিমায় আলাদা জায়গা করে নিয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ‘প্যাঁরা সন্দেশ’। ইতোমধ্যেই ইউরোপ-আমেরিকার নানা উন্নত দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালির অনেক প্রিয় খাবার হয়ে উঠেছে এটি।

গরুর খাঁটি দুধের ঘন ক্ষীর এবং চিনির মিশ্রণে তৈরি হওয়া এই মিষ্টির স্বাদ-গন্ধ অন্য মিষ্টির চেয়ে একটু আলাদা ও সুস্বাদু। শুকনো হওয়ায় দূর-দূরান্তে বহনেও বেশ সুবিধা। আর এ জন্যই মানুষের কাছে রসালো মিষ্টির চেয়ে এই মিষ্টি অধিক পছন্দের। উপজেলায় অনেক মিষ্টির দোকান থাকলেও কালাচাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডার, মধু মিষ্টান্ন ভান্ডার, বর্দ্ধন মিষ্টান্ন ভান্ডার ও সংগীতা মিষ্টান্ন ভান্ডারে তৈরি হওয়া ‘প্যাঁরা সন্দেশ’ স্বাদে অতুলনীয় বলে জানা গেছে। 

উপজেলার অধিকাংশ মিষ্টি ব্যবসায়ী জানান, সরিষাবাড়ীতে এসেছেন অথচ প্যাঁরার স্বাদ নেন নি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। এটি এ অঞ্চলের গর্ব। বাপ-দাদার আমল থেকেই তারা এটি তৈরি করছেন। হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুধের ক্ষীর এবং আখের রসের মিশ্রণে একধরনের সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরি হতো। সেই থেকে ধীরে ধীরে প্যাঁরা সন্দেশ বা মিষ্টিতে রূপান্তর হয়। এটি তৈরিতে তুলনামূলক পরিশ্রম বেশি হলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় উপজেলার প্রত্যেকটি মিষ্টির দোকানে এটি পাওয়া যায়। যারা এর ভক্ত, তারা রীতিমতো ফরমায়েশ দিয়ে সংগ্রহ করে নেন। বর্তমানে এই ‘প্যারা সন্দেশ’ ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশ লন্ডন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। 

সরিষাবাড়ীর বাসিন্দা জাকারিয়া জাহাঙ্গীর। ছাত্রাবস্থায় যিনি সবসময় প্যারা সন্দেশের অতিশয় ভক্ত। শুধু তিনিই নন তার পরিবারের সকলেই এই সন্দেশ খেতে খুব পছন্দ করেন। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, প্যারা সন্দেশ স্বাদে-মানে ও গুণে অতুলনীয়। এটি শুকনা থাকায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বগুড়ার দই যেমন দুধ থেকে তৈরি, তেমনি সরিষাবাড়ীর প্যারা সন্দেশও দুধ থেকেই তৈরি। সম্প্রতি বগুড়ার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে আমরাও সরিষাবাড়ীবাসী চাই সরিষাবাড়ীর এই ঐতিহ্যবাহী প্যারা সন্দেশকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক।

বর্দ্ধন মিষ্টান্ন ভান্ডারে রাসেল মিয়া নামে এক ক্রেতার সাথে দেখা। তিনি বিশেষ কাজে জেলা শহর থেকে সরিষাবাড়ীতে এসেছেন। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, কোন কাজে সরিষাবাড়ীতে আসলেই পরিবারের জন্য এই বিখ্যাত প্যাঁরা সন্দেশ নিয়ে যান। কেননা পরিবারের খুবই প্রিয় এই সুস্বাদু খাবার। বিশেষ করে শিশুরা খুবই পছন্দ করে এই মিষ্টি। আমরা চাই বিখ্যাত এই প্যারা সন্দেশের সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।

উপজেলার শিমলাবাজারের কাঁলাচাদ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী সুমন ঘোষ বলেন, প্রতিদিন তার দোকানে বিভিন্ন রকম মিষ্টি তৈরি হলেও সবার দৃষ্টি থাকে ‘প্যাঁরা সন্দেশ’ এর প্রতি। এটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। প্রতিদিন তার দোকানে গড়ে ৮০-১০০ কেজি প্যাঁরা সন্দেশ তৈরি হয়। নিজ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইল ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই এই প্যাঁরা সন্দেশ সরবরাহ করে থাকেন তিনি।

এছাড়াও তিনি জানান, তার দোকানের প্যাঁরা সন্দেশ আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি-আরব, দুবাই প্রভৃতি দেশসমূহে অবস্থানরত প্রবাসীদের কাছে সরবরাহ হয়ে থাকে। শুকনো মুড়ির পাত্রে দেড় থেকে দুই মাস সংগ্রহ করে খাওয়া যায়। বিধায় বিদেশে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের নিকট প্যাঁরার কদর একটু বেশি। এই মিষ্টির সবটুকুই দুধের ওপর নির্ভর করতে হয় বলে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় দাম একটু বেশিই হয়ে থাকে। একসময় ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১ কেজি প্যাঁরা সন্দেশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকা দরে। ৪০-৪৫টি প্যাঁরা সন্দেশ এক কেজি ওজনের হয়ে থাকে।

কারিগর চন্দন পাল। ৩০ বছর যাবত তিনি এই প্যাঁরা সন্দেশ তৈরির সাথে জড়িত। তিনি বলেন, বাইরে থেকে দেখে প্যাঁরা সন্দেশ বানানো সহজ মনে হলেও আসলে ততোটা সহজ নয়। দুধের ক্ষীর তৈরি করে তাতে চিনি ও ক্ষীরের মিশ্রণের একটা সঠিক অনুপাত প্রয়োজন হয়। আর এই অনুপাতের তারতম্য ঘটলে এর স্বাদ ও গুণগত মান উভয়ই নষ্ট হয়ে যায়। কারিগর হিসেবে দেশের অনেক অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করলেও সরিষাবাড়ীর প্যাঁরা সন্দেশের স্বাদ দেশের অন্য অঞ্চলের মিষ্টির চেয়ে সেরা বলে তিনি দাবি করেন।

জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, দেশের প্রত্যেক এলাকায় বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি হয়। যেমন- টাঙ্গাইলের চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বিক্রমপুরের মিষ্টি-দধি, বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই। তেমনি জামালপুরেও মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষত্ব থাকলেও প্রচার প্রচারণার অভাবে এটি তেমন পরিচিতি পায় নি। জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার প্যাঁরা সন্দেশ বেশ প্রসিদ্ধ। তবে টাঙ্গাইল, নাটোর, কুমিল্লা, বগুড়া ও বিক্রমপুরের মতো এতো জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। এটার একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে- জামালপুরটা আসলে বিভাগীয় শহর নয়, এই জেলার সাথে আন্তঃজেলার সংযোগ খুব কম। দেশের এক প্রান্তে থাকায় জামালপুর হয়ে খুব কম জেলার লোক যাতায়াত করে। এইজন্য এই জেলার মিষ্টি প্রসিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও পরিচিতি পায়নি। তাই তিনি মনে করেন, যেখানে অন্য জেলার সাথে যাতায়াতের রাস্তা রয়েছে সেখানে যদি এই প্যারা মিষ্টির শো-রুম করা যায় তাহলে এর পরিচিতি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও টিভি, পত্র-পত্রিকায় যদি প্রচারণা করা যায়- তাহলে ভবিষ্যতে বগুড়ার দইয়ের মতো জিআই পণ্য হিসেবে খুব সহজে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে সরিষাবাড়ীর এই ‘প্যারা সন্দেশ বা প্যারা মিষ্টি’।