ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আইনজীবী সুরক্ষা আইন: বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য একটি পদক্ষেপ

এডভোকেট মোঃ সরোয়ার হোসাইন লাভলু | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০২:১২:০০ অপরাহ্ন | মতামত
এডভোকেট মোঃ সরোয়ার হোসাইন লাভলু

বাংলাদেশে আইনজীবীরা বিচার ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি এবং আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তাদের পেশাগত কার্যক্রমের সুরক্ষা ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে, এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইনজীবী মহলে গভীর শোকের সৃষ্টি করেছে এবং সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আইনজীবীদের সুরক্ষা: কেন প্রয়োজন?

আইনজীবীরা তাদের পেশাগত জীবনে বিভিন্ন ধরনের চাপ এবং ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন। কখনোসখনো তারা মামলার পক্ষের প্রতিপক্ষের হুমকি বা শারীরিক আক্রমণের শিকার হন। এর ফলে তাদের শারীরিক নিরাপত্তা এবং পেশাগত স্বাধীনতা সংকটের মুখে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আইনজীবীদের সুরক্ষার জন্য কার্যকরী কোনো আইন নেই, যা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। শুধু আইনজীবীরা নয়, বরং পুরো বিচার ব্যবস্থার কর্মী এবং সংস্থাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়নের প্রয়োজন।

এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ড তার প্রমাণ, পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার পথে আদালত অঙ্গনের পাশে ইসকন জঙ্গীদের হামলায় নিহত হয়েছেন। এছাড়াও অনেক আইনজীবী শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে হুমকি ও হামলার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আইনজীবীদের সুরক্ষায় কোন আইন না থাকার কারণে পুলিশসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইনজীবীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ গ্রহণ করে বিভিন্নভাবে হেনেস্থার স্বীকার করে থাকেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে আইনজীবীদের নিরাপত্তা এবং মর্যাদার সুরক্ষা নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মৌলিক অংশ। তাদের সুরক্ষা ছাড়া সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।

বর্তমান আইনের সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশে আইনজীবীদের সুরক্ষা নিয়ে কিছু বিধান থাকলেও তা কার্যকরী নয়। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২ এর আওতায় আইনজীবীদের শৃঙ্খলা এবং পেশাগত আচরণ নির্ধারিত হলেও, তাদের শারীরিক নিরাপত্তা এবং পেশাগত সুরক্ষা নিয়ে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান দণ্ডবিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আইনগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে বিধান থাকলেও, এসব আইন আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়।

অতএব, একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করা জরুরি, যা আইনজীবীদের শারীরিক, মানসিক এবং পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। এই আইনটি শুধু আইনজীবীদের নয়, বরং বিচারক, প্রসিকিউটর, আদালত কর্মীসহ সকল বিচারবিভাগীয় কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

আইনজীবী সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবনা

একটি আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন হলে এর মাধ্যমে নিম্নলিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হবে:

১. সহিংসতা ও হুমকি রোধ: আইনজীবীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা হুমকি প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকবে।

২. ত্বরিৎ বিচার ব্যবস্থা: আইনজীবীদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ বা হুমকি ঘটলে দ্রুত বিচার এবং শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা হবে।

৩. সুরক্ষা ব্যবস্থা: আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের পেশাগত কাজের সময় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৪. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: আইনজীবীদের সুরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে, যাতে তারা তাদের সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন থাকেন।

৫. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ: সরকারকে আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ: অন্যান্য দেশের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত

আইনজীবীদের সুরক্ষা বিষয়ে অনেক দেশেই উচ্চ আদালতের উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে:

১. ভারত - কেরালা হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত (২০১৯): কেরালা হাইকোর্ট, ২০১৯ সালে, আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয়। আদালত সিদ্ধান্তে জানায় যে, আইনজীবীদের উপর আক্রমণ এবং হুমকি দেয়াটা আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করা। আদালত সরকারের কাছে আইনজীবীদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয়, যাতে তারা নিরাপদভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আদালত এও বলেন যে, আইনজীবীদের স্বাধীনতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।

২. যুক্তরাজ্য - রুল অফ ল ফাউন্ডেশন (২০১৮): যুক্তরাজ্যের রুল অফ ল ফাউন্ডেশন, ২০১৮ সালে, আইনজীবীদের জন্য একটি বিশেষ সুরক্ষা নীতি প্রবর্তন করে, যা কেবল তাদের শারীরিক সুরক্ষার বিষয়টিই নয়, বরং পেশাগত স্বাধীনতা এবং মর্যাদাও সুরক্ষিত করে। রুল অফ ল ফাউন্ডেশন চিহ্নিত করে যে, আইনজীবীদের প্রতি আক্রমণ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আক্রমণ, যা গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৩. আমেরিকা - নিউইয়র্ক স্টেট বার অ্যাসোসিয়েশন রুল (২০১৭): নিউইয়র্ক স্টেট বার অ্যাসোসিয়েশন ২০১৭ সালে একটি রুল জারি করে, যেখানে বলা হয় যে, যদি কোনো আইনজীবীর ওপর শারীরিক আক্রমণ করা হয়, তবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সহায়তায় দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে একটি বড় সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আইনজীবীদের সুরক্ষা এবং মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে। বাংলাদেশে একটি আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন জরুরি, যা আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এই আইন প্রণয়ন শুধু আইনজীবীদেরই নয়, দেশের সমগ্র বিচার ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করতে হবে, যাতে আইনজীবীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন নিরাপদ এবং স্বাধীনভাবে।

লেখক: এডভোকেট মোঃ সরোয়ার হোসাইন লাভলু

অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম