ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

উচ্চশব্দে ডিউটি: কানে কম শোনা, হৃদরোগসহ নানা ঝুঁকি ট্রাফিকের

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শনিবার ৪ জুন ২০২২ ০৩:৩৫:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ট্রাফিক বিভাগে চাকরি করেন বনানী জোনের পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) কামরুল হাসান। ঢাকার শব্দদূষণের কারণে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। রাস্তায় ডিউটি শেষ করে বাসায় গিয়ে মেজাজ থাকছে খিটখিটে। পরিবারের লোকরা মনে করেন তিনি হয়তো কোনো কারণে তাদের ওপর বিরক্ত। রাস্তায় ডিউটি করার কারণে পরিবারে গিয়েও তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে হচ্ছে। কারণ তিনি সারাদিন রাস্তায় ডিউটি করে মনে করছেন তিনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন। এমনকি পরিবারের সঙ্গে টেলিভিশন দেখতে গিয়েও ট্রাফিক সদস্য কামরুল হাসান সাউন্ড বাড়িয়ে দেখছেন, এতে পরিবারের অন্যদের সমস্যা হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে অনেক সময় জেগে যাচ্ছেন। ট্রাফিক সদস্যরা স্বাভাবিক শব্দের চাইতে উচ্চস্বরে শব্দের সঙ্গে বেশি এডজাস্টেবল।

শুধু কামরুল হাসান নন। ১০ বছর ধরে ট্রাফিকে চাকরি করা মতিঝিল জোনের পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) মো. মেজবা উদ্দীনও প্রায় একই সমস্যায় ভুগছেন।

শব্দদূষণে মূলত সব ট্রাফিক সদস্যের কানের সমস্যা হয়। এছাড়া মানসিকভাবে সব সময় ঝামেলায় থাকতে হয়। সড়কে ডিউটিরত ট্রাফিক সদস্যদের সব সময় স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হয়। এ কারণে স্বাভাবিক কাজকর্মে মন বসাতেও কঠিন হয়ে যায়। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। লিখিত অভিযোগ না করলেও ট্রাফিকের বেশিরভাগ সদস্য মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। 

তিনি বলেন, শব্দদূষণের কারণে তাদের কানে সমস্যা হয়। দীর্ঘদিন সড়কে কাজ করতে গেলে পেটের নানাবিধ সমস্যাও হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়, অতিরিক্ত শব্দের কারণে বাসায় গিয়েও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা সম্ভব হয় না। রাস্তাঘাটে কথা বলতে গেলে তাদের উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়। এভাবে কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে গেলেও তারা সবসময় উচ্চস্বরে কথা বলছেন। তবে উচ্চস্বরে কথা নিজের অবচেতন মনেই বের হয়ে যাচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করা যায় না। খাওয়ায় অরুচি হয়। স্বাভাবিক শব্দের চাইতে বেশি ডেসিবলের শব্দ সবসময় ট্রাফিক সদস্যদের চারপাশে হচ্ছে। ঢাকার কোনো কোনো জায়গায় ৭০ থেকে ৮০ ডেসিবল অথবা তার চেয়েও অনেক বেশি অনেক জায়গায় হচ্ছে।

ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের বেশিরভাগ সদস্যের প্রায় সময় প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করে, রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, বাসায় গিয়ে বিনা কারণে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ দেখান। কার শ্রবণশক্তি এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, পেপটিক আলসার, উৎকণ্ঠা ও অমনোযোগী ভাব দেখা দিচ্ছে।

সম্প্রতি ভারতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের ৮৪ ভাগ সদস্যই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আর শ্রবণশক্তি কমে গেছে ৬৫ শতাংশ সদস্যের। মূলত রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করায় বায়ু ও শব্দদূষণের কারণেই এসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ৩৮৪ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের ওপর পরিচালিত এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে দেশটির জার্নাল অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল রিসার্চে।

গত বছর প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০ শতাংশ ট্রাফিক সদস্য ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। ঘুমের মধ্যে ৫৬ শতাংশ কানে সার্বক্ষণিক বিকট শব্দ শুনতে পান। ২৭ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

শব্দদূষণজনিত রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন ৮০ জনের ওপর রোগী আমাদের দেখতে হচ্ছে। যারা কানের সমস্যায় আসছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ট্রাফিক সদস্য, গাড়িচালক ও কল সেন্টারে (কানে হেডফোন লাগিয়ে যাদের ডিউটি) কাজ করেন। এদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। যেসব রোগী আসেন তাদের বেশিরভাগ কানে কম শুনতে পাওয়া, কানে শব্দ হওয়া, মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ করা, মাথা ব্যথা, শারীরিক অবসাদ ও রাস্তা পার হতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা রোগীরা শেয়ার করছেন। 

গত বছর ডেনমার্কের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মোটর গাড়ির হর্ন, সাইরেন ও অন্যান্য ট্রাফিক নয়েজের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ে ২৭ ভাগ পর্যন্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চশব্দের উৎসের কাছে দীর্ঘদিন কাজ করলে একজন মানুষের শ্রবণক্ষমতা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শব্দদূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্মগ্রহণ করতে পারে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন মতে শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর প্রথম স্থানে রয়েছে ঢাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমোদনযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডিবি এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডিবি পাওয়া গেছে।

তিন বছর বা তার কম বয়সী শিশু যদি খুব কাছ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ শোনে তাহলে সে শিশুটি চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন অনেক স্কুলগামী শিশু শ্রবণশক্তি হারাতে বসেছে। উচ্চশব্দ শুধু শ্রবণশক্তিই নষ্ট করে না সৃষ্টি করে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এমনকি মানসিক বিকাশের জন্যও এটি ক্ষতিকর। আমাদের দেশে হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালানোর কথা-চিন্তাই করা যায় না। মাঝে মাঝে কানের কাছে এমন বিকট শব্দে হর্ন বাজানো হয় যে আঁতকে উঠতে হয়।