ভারতে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের সন্ত্রাস দমনে এক সাহসী যোদ্ধা ছিলেন জেনারেল বিপিন রাওয়াত। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) সেনা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যান ৬৩ বছর বয়সী জেনারেল বিপিন রাওয়াত, তার স্ত্রী, প্রতিরক্ষা সহকারী, নিরাপত্তা কমান্ডো, বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাসহ ১৩ জন। তিনি ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভারতের প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের নতুন বিভাগের প্রধান হিসেবেও তিনি নিয়োগ পান। তার মৃত্যুতে ভারত একজন দক্ষ যোদ্ধাকে হারালো।
বিপিন রাওয়াতের কর্মজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিশন ছিল মিয়ানমারের এনএসসিএন-কে গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের জুন মাসে এনএসসিএন-কে গোষ্ঠীর হামলায় মারা যান ১৮ ভারতীয় সেনা। এ ঘটনার পাঁচদিন পর মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং নিহত হয় শতাধিক। এই অভিযানে সফল হওয়ার মূল কারিগর ছিলেন বিপিন রাওয়াত।
এ অভিযানের এক বছর পর উরি হামলার প্রতিবাদে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনা। হামলার প্রস্তুতি থেকে অপারেশনের নজরদারি সবকিছুই পরিচালনা করেছিলেন বিপিন রাওয়াত।
দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় কমান্ডার হিসেবে কাজও করেন বিপিন রাওয়াত। বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীর ও অরুণাচল প্রদেশে কাজ করেন তিনি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের হয়েও গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে কাজ করেন বিপিন। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করায় পুরস্কৃতও হন তিনি।
দক্ষ কর্মকর্তা বিপিন রাওয়াত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রিয় ছিলেন। বিতর্ককে আমলে না নিয়ে দুই বর্ষীয়ান সেনা কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে রাওয়াতকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন রাওয়াত। ২০১৯ সালে রাওয়াতের অবসরের ঠিক সাতদিন আগে, ২৪ ডিসেম্বর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফের পদ ঘোষণা করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। আর রাওয়াতের অবসরের ঠিক একদিন আগে ওই পদে নিযুক্ত করা হয় তাকে। সরকারের সঙ্গে তিন সামরিক বাহিনীর সংযোগ রক্ষাকারী ‘সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইজার’ হিসেবেও নিযুক্ত হন তিনি।
গালওয়ান উপত্যকা নিয়ে চীনের সঙ্গে বিরোধ, কাশ্মীর সংকট, সম্প্রতি নাগাল্যান্ডে সেনার গুলিতে সাধারণ গ্রামবাসীর মৃত্যুতে অশান্ত উত্তর-পূর্ব নিয়ে যখন কিছুটা বিব্রত বিজেপি সরকার তখন রাওয়াতের মৃত্যুতে নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হলো।
ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, পদাধিকার বলে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকা ‘নিউক্লিয়ার কমান্ড অথরিটি’র একজন সদস্য এবং তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পরামর্শদাতা কমিটির প্রধানও তিনি। সামরিক ক্ষেত্রে গোলাবারুদ থেকে অস্ত্র কেনা, সবক্ষেত্রেই অন্যতম পরামর্শদাতা হলেন সিডিএস। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী সরকার যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা বা যে কোনো মুহূর্তে অভিযানের জন্য বাহিনীকে প্রস্তুত রাখার প্রশ্নে তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে ‘ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড’ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। যেটি শুরু হয়েছিল রাওয়াতের নেতৃত্বে।
বিপিন রাওয়াতের যোগ্য বিকল্প সহজে পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে তিন স্টাফের প্রধান হিসেবে এমন একজনকে বেছে নিতে হবে যিনি পদমর্যাদায় তিন বাহিনীর কোনো একটিতে সর্বাধিনায়ক ছিলেন বা ন্যূনতম ‘ফোর স্টার শ্রেণির’ অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছেন এবং যার সঙ্গে সরকারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সাবেক কোনো সেনাপ্রধানের সঙ্গেই পরবর্তী সিডিএসের দৌড়ে রয়েছেন বর্তমান সেনাপ্রধান এম এম নরবণে। বাকি দুই প্রধানের মধ্যে তিনিই এই মুহূর্তে বয়সের দিক থেকে সিনিয়র। নৌসেনা প্রধান অ্যাডমিরাল আর হরি মাত্র এক সপ্তাহ আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বিবেকরাম চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র আড়াই মাস আগে। সেখানে নরবণে আগামী এপ্রিল মাসে অবসর নিতে যাচ্ছেন। তবে সিনিয়রিটির বিষয়টি বিবেচনায় করলে নরবণেই আপাতত এগিয়ে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।